গল্প

নূরজাহান ভিলা

তিনপাশে দেয়ালঘেরা একটি টিনশেড দোতলা ঘর। শহরের প্রতিটি বাড়ির নাম থাকলেও এই বাড়িটির কোন নাম ছিলো না। ঘরের পাশেই একটি কামিনী ফুল গাছে সবুজে-সাদায় মাখামাখি হয়ে থাকতো বছরের বেশিরভাগ সময়। রাস্তার দেয়ালের পাশেই একটি সন্ধ্যামালতী ফুল গাছ ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকতো, যার কিছু ডাল দেয়াল টপকিয়ে রাস্তার ওপরও ঝুলে থাকতো। জবা ফুল গাছটা এতো ঝাকড়া হয়ে ডালপালা বিছিয়ে থাকতো যে, সকালে উঠে আমি যখন ব্যালকনি থেকে গাছটার দিকে তাকাতাম মনে হতো আগুন লেগেছে। একটা মধ্যম আকৃতির শিউলী গাছ ঝাঁকড়া পাতা নিয়ে শরতের অপেক্ষা করছিলো। গত শরতে আমি যখন প্রথম এই বাসায় উঠেছিলাম সন্ধ্যায় জানালা খুলে দিলেই ঘরটা শিউলীর ফুড়ফুড়ে গন্ধে ভরে যেতো। উঠানের ওপরে বিরাট কামরাঙা গাছটিতে অজস্র কামরাঙা ধরেছে। প্রতিদিন অসংখ্য টিয়ে এসে কামরাঙাগুলো কুঁচি কুঁচি করে গাছের তলায় ফেলতে থাকে। টিয়ে পাখিগুলো তাড়ানোর জন্য গাছের সাথে একটা টিন বেঁধে রাখা হয়েছে, একটি লম্বা দড়ি টিনশেড ঘরটির সামনের বারান্দা থেকে টিনটি পর্যন্ত চলে গিয়েছে, যেটায় টান দিলে ঝনঝন শব্দ হয়। এই শহরের আর কোন বাড়িতে এতোখানি খালি জায়গা ও এতো গাছপালা নজরে পড়ে নি।

শহরের মধ্যে সাহা পাড়ার এই বাড়িটির ঠিক বিপরীতেই আরেকটা বাড়ির দোতলা একটি ঘরে আমার বাস। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বাড়ির গৃহকত্রীর ও আশেপাশের হিন্দু বাড়িগুলো থেকে আসা নারীদের পূজার ফুল তোলা দেখতে না পারলে; কামরাঙা গাছটিতে সকালে দোয়েলের শীস, টুনিটুনির টিউ টিউ বা কাকের কা-কা না শুনলে আমার যেন সকাল হয় না। কিছুদিন হলো জামরুল গাছটিতেও অজস্র ফুল ধরেছে। আামি প্রতিদিন জামরুল ফুল দেখি, কচি কচি জামরুল দেখি, আর ভাবি ক’দিন পরে জামরুল গাছটিও সাদা হয়ে যাবে।

আমার অফিসে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় আমি পরশু থেকে সারাদিনই বাসায় ছিলাম। গতকাল দুপুরে খেয়াল হলো সকাল থেকে কামরাঙা গাছটিতে টিনের সাথে বাঁধা দড়িটিতে একবারের জন্যও কেউ টান দেয় নি। আমি ব্যালকনিতে গেলাম। জবা ফুল গাছটা বরাবরের মতো লাল হয়ে আছে। সন্ধ্যামালতী গাছটায় আজ অনেক বেশি ফুল। প্রতিদিনের মতো ঠাকুর পূজার জন্য কেউ ফুল তুলেছে বলে মনে হলো না। কামরাঙা গাছটিতে অনেক টিয়া ডাকছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ টিয়েদের ডাক শুনলাম, ওদের লাল ধারালো ঠোঁট দিয়ে কামরাঙা কাটা দেখলাম।

গতকাল ছিলো রবিবার। প্রতি সপ্তাহের প্রথম দিনের মতো গতকালও অফিসে খুব কাজের চাপ ছিলো। অফিস থেকে ফিরতে রাত আটটা বেজে গিয়েছিলো। অভ্যাসমতো বাসায় ঢুকেই ব্যালকনিতে গিয়েছিলাম। বিদ্যুতের আলোয় যা দেখলাম তাতে আমি যেন আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার সামনের বাড়িটার সব কটা ফুল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কামিনী ও সন্ধ্যামালতী ফুল গাছটাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কাটা ডালগুলো এখনো ফুল-পাতায় ভরা। জবা ফুল গাছটার গোড়াটাকে তুলে ফেলার জন্য অনেকখানি মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। আসছে শরতে আমার জানালা খুলে দিলেও কোন শিউলী সুবাস ছড়াবে না ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো; মনে হচ্ছিলো বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই। আমি দ্রুত ঘরে ঢুকলাম।

প্রতিদিনের অভ্যাসমতো সকালে ঘুম থেকে জেগেই সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। বাড়িটির দরজায় একটি নেইমপ্লেট দেখলাম। সেখানে লেখা, নূরজাহান ভিলা। আরো একটি প্লেট নজরে এলো; সেখানে লেখা- “ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক।“

রাতের মতোই ফের অসুস্থ বোধ করছিলাম। আমার চোখে কেবলই বাড়ির প্রাক্তন অধিবাসীদেরকে মনে পড়ছিলো। হয়তো তারা এখন ওপার বাংলার কোন বস্তিতে, কোন কলোনিতে কোন মতে যাপন করছে জীবন; হয়তো সেই গৃহকত্রীকে পূজার ফুল আনতে হেঁটে যেতে হয় খানিকটা পথ; হয় তো তাকে গালমন্দ শুনেও অন্য বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করতে হয়; হয়তো রাস্তায় বিক্রি হওয়া কামরাঙা-জামরুল দেখে গৃতকর্তার কল্পনা-চোখে ভেসে ওঠে ওপারে তার বাড়ির ফল গাছগুলোতে এখন সারি সারি কামরাঙা ধরেছে, জামরুলে সাদা হয়ে গিয়েছে গাছের তলা; হয়তো দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে আবার পথ চলে।

এই সাহা পাড়ার হিন্দু বাড়িগুলো ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। একদিন সব বাড়িগুলোই হয়তো মুসলমান মালিকদের হয়ে যাবে। তখনও হয়তো এ পাড়াকে সবাই সাহা পাড়াই ডাকবে। তারপর একদিন এই সাহা পাড়া নামটিও বিলুপ্ত হবে। হয়তো নামটি হবে ইসলাম পাড়া বা মোহাম্মদ নগর বা রসুলপুর।

আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমার বমি বমিবোধ হচ্ছে। ধর্মের বীভৎসতায় মানুষের জীবন নিয়ে এই ভূ-রাজনৈতিক খেলাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

3 Comments

Leave a Comment