বেহুলার সংসার

যে বহুভুজের ক্ষুদ্র সরলরেখাগুলো বরাবর আমার প্রতিদিনের আসা-যাওয়া আজ তারই এক প্রান্তে বেহুলার সাথে দেখা। ঠিক চিনতে পারছিলাম না, সেই কবে কোন ছোটবেলায় মনসামঙ্গল গানে তাকে দেখেছিলাম যখন আমি কোন ক্লাসেই ভর্তি হইনি। প্রায় ত্রিশ বছর আগের কোন এক রাতে আমাদের বাড়ির উঠোনে খোল-করতাল-সানাই ও হারমোনিয়ামের বাজনার তালে তালে রং-মাখা মুখায়বে তার নৃত্য সেকি আজও মনে থাকার কথা! তবে মনে আছে সেদিন আমারই বয়সী আমার এক ভাই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট চুরি করে দোকানে রাজা বেলুন মতান্তরে কনডম কিনতে গিয়েছিল।

সেসব কথা থাক। বেহুলা জানালো যে, সে এই বহুভুজের তৃতীয় কর্নারে একটি ত্রিভুজে বাস করে। আমি চাইলে ওর ত্রিভুজালয়ে খানিকটা কাটিয়ে আসতে পারি, অথবা আমার অফিসে যাওয়া-আসার ফাঁকে যদি কখনো তৃষ্ণা পায়, একটু জল খেয়ে জিরিয়ে নিতে পারি।

সেদিন অফিসে যাওয়ার যথেষ্ট তাড়া ছিল বলে বসতে পারিনি। বসার ইচ্ছাও ছিল না অবশ্য। কোথাকার কোন মেয়ে নিজেকে বেহুলা পরিচয় দিয়ে আমাকে ব্লাকমেইলও তো করতে পারে! আজকাল হরহামেশাই এসব হচ্ছে।

ফেরার পথে দেখি বেহুলা একেবারে তার ত্রিভুজালয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই ওর অপ্সরা-টাইপ মুখে একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘একটু বসবে?’

নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছিল। সুন্দরীদের থেকে সবসময়ই ১০০ গজ দূরত্ব বজায় রাখা আমি বেহুলার সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। তাছাড়া এই বহুভুজের চতুর্থ কর্নারে এই ত্রিভুজটার অস্তিত্ব আগে কোনদিনই আমি খেয়াল করিনি। মর্নিং ওয়াক, বাজার করা কিংবা অফিসে যাওয়া-আসা সবসয়ই আমি এই বহুভুজের রেখাগুলো বরাবরই চলে থাকি। অথচ কোনদিনই আমি এই ত্রিভুজটিকে এখানে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বছরের প্রথম বৃষ্টির পরে উঁইয়ের ঢিবিতে গজানো ব্যাঙের ছাতার মত আজকাল যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র, রম্বস আর ট্রাপিজিয়ম। সম্ভবত এজন্যই নজরে পড়েনি।

আমাকে বসিয়ে বেহুলা তালপাখা দিয়ে বাতাস করতে শুরু করল। চরম অস্বস্তিতে আমি আরো ঘেমে উঠছি। আশেপাশে বা ঘরের মধ্যে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। জানতে চাইলাম, ‘এখানে কি তুমি একা থাক?’
খলখলিয়ে হেসে উঠল বেহুলা। ‘তুমি বোকাই রয়ে গেলে, অনুপ। একা আমি কিছুতেই থাকতে পারি না, সে তুমি জানো। তা যদি পারতাম তাহলে স্বর্গে গিয়ে নেচে গেয়ে দেবতাদের খুশি করার মত ঝুঁকি নিতাম না। অসীমটা আজ আসবে না। সকালেই মোবাইল করে জানিয়ে দিয়েছে, তাইতো তোমাকে পথে আটকালুম।’
আমি বোবা হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।
‘কী ভাবছো?’ বেহুলা বললো।
‘না, ভাবছিলাম অসীমটা আবার কে। তোমার লখিন্দর?’
‘সেতো সেই কবেই সাপের কামড়ে মারা গেল! তুমি সবকিছু ভুলে গেলে?’
বেহুলা এমনভাবে কথাগুলো বললো তাতে মনে হলো যেন লখিন্দরের মৃত্যু তার ওপর কোন প্রভাবই ফেলেনি। আমি বললাম, ‘আমি নিজের চোখে দেখলাম তুমি দেবতাদের তুষ্ট করে লখিন্দরের জীবন ফিরিয়ে আনলে! আমাদের উঠোনেই তো ঘটলো সব, কয়েকশ লোকের চোখের সামনে।’
বেহুলা হাসলো, ‘তুমি যা বলছ তা পৌরাণিক সত্য। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ যখন আন্দোলন শুরু করল যে লখিন্দর আসলে বাঁচার অধিকার রাখে না, কারণ লখিন্দরকে যে সাপে কামড়েছিল তা আদৌ বিষধর নয়, পুরো বিষয়টা আসলে অতিনাটকীয়তা এবং মানুষকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা, তখন লখিন্দর অপমানে লজ্জায় হার্ট-এটাক করলো এবং মারা গেল। বেচারা!’
‘ডাক্তার ডাকোনি?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘ডাক্তাররাই তো বিদ্রোহের সূচনা করেছিল, বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী নাকি তাদের উপার্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল। কেউ সাপে কাটলে মানুষ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে দেবতাদের ধর্ণা দেয়া শুরু করেছিল।’
বেহুলা-লখিন্দরের নতুন ইতিহাস শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তবে মুখে তা প্রকাশ করলাম না। বললাম, ‘তা এই অসীমটা কে?’
‘আমার বয়ফ্রেন্ড,’ বেহুলা সাথে সাথে উত্তর দিলো।
‘তুমি……..মানে…….তোমার বয়ফ্রেন্ড!’
‘অবাক হচ্ছ কেন? আমার সতীত্ব স্বর্গেই বিসর্জন দিয়ে এসেছিলাম, মর্ত্যে আমি তোমার মতই একজন মানুষ।’

আরো অনেক কথাই হলো বেহুলার সাথে। ত্রিভুজ থেকে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা। সরলরৈখিক আমি আবার বহুভুজের পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। ফেরার পথে টের পেলাম বহুভুজটার একটা বাহুতে ফাটল ধরেছে। ফাটলটার পাশে বসে পড়লাম। অনেকক্ষণ বসে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম ফাটলটা কতখানি ভয়ংকর হতে পারে পথচলার জন্য। ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে পুরো বাহুটিকে মুছে ফেলে আবার নতুন করে দাগ টানলাম। কিন্তু যতবারই দাগ টানছি ততবারই ফাটলটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

সব ফেলে দিয়ে আবার ত্রিভুজ বরাবর হাঁটা শুরু করলাম। বেহুলাকে ফাটলটা সম্পর্কে বলতেই হবে। ত্রিভুজালয়ের কাছে পৌঁছাতেই শুনতে পেলাম বেহুলার তীক্ষ্ম গলা – ‘ঘরে তুমি শুধু পর-পুরুষের গন্ধ পাও? কেন আমার শরীরের ঘ্রাণ কি তোমার নাকে যায় না?’

আমি ফেরার জন্য পা বাড়াই। বেহুলাকে ফাটলটার কথা বলা হলো না। নিজেই ফের মেরামতে নিয়োজিত হই, কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না।

পরদিন সকালে উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে একটু আগেই রওয়ানা হই অফিসের উদ্দেশে। দূর থেকেই ত্রিভুজালয়টাকে খোঁজার চেষ্টা করি।

নেই। যেখানে ত্রিভুজটা ছিল, সেখানে কেবলই একটি ৪৫ডিগ্রী অন্তস্থ কোণ।

2 Comments

Leave a Comment