প্রবন্ধবাংলাদেশসংখ্যালঘু নির্যাতন

বাংলাদেশের হিন্দুঃ একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি (পর্ব-১)

বাংলাদেশের বেশিরভাগ শহর, গ্রাম, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নামগুলোর দিকে একটু নজর দিলে দেখবেন এই নামগুলোর সাথে হিন্দু ব্যক্তি, দেবতা ইত্যাদির নাম খুব স্পষ্টভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়ই এটি খুব স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানের চিত্র দেখলে হয় তো দেখবেন, কোন হিন্দু ব্যক্তির নামের রাস্তায় কিংবা গ্রামে একজনও হিন্দু নেই। তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। সত্যিকারার্থে তাদেরকে উধাও করে দেয়া হয়েছে।

জমিদাররা সবসময়ই অত্যাচারী ছিলো এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অনেক হিন্দু জমিদার, হিন্দু ব্যবসায়ীরা একইসাথে শিক্ষাবিস্তারের প্রতি বেশ উৎসাহী ছিলো। বরিশালের কথাই যদি ধরেন, দেখবেন- এই শহরের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথেই জড়িত আছে হিন্দু জনহিতৈষীদের নাম। অশ্বিনীকুমার দত্তের কোন উত্তর-প্রজন্মই আর বাংলাদেশে নেই, কিন্তু তাদের নাম মুছে ফেলা কি সম্ভব হবে কোনদিন? বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল, অশ্বিনীকুমার টাউন হলসহ অনেককিছুরই প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এছাড়া নারীশিক্ষার জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি, (সম্ভবত) এটিই এখন বরিশাল মহিলা কলেজ। এমনকি নিজের বাড়িটাও বরিশালবাসীকে দান করে গেছেন।  তবে তাঁর নামও যে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় নি, তা নয়।

পাকিস্তান শাসনামলে অশ্বিনীকুমার টাউনহলের নাম পরিবর্তন করে আইয়ুব খান টাউন হল নামকরণের প্রচেষ্টা রুখে দেয় ছাত্ররা। সেজন্যে ছাত্ররা পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়। শেষে ওটার নাম পরিবর্তিত করে ‘এ কে টাউন হল’ নামকরণ করা হয়, কিন্তু ছাত্র-জনতা এ.কে মানে আইয়ুব না পড়ে অশ্বিনীকুমার হিসেবে ধরে নিয়েছেন, এখন অবশ্য ওটা অশ্বিনীকুমার টাউন হল নামেই পরিচিত। তবে দেশের ইসলামিকীকরণের যে হিড়িক চলছে, তাতে এসব নাম কতোদিন টিকবে তা বলা যায় না। মন্ত্রীপরিষদের একটি বৈঠক এবং রাষ্ট্রপতির একটা স্বাক্ষরই তো দরকার। দেশের যে হাল, ভবিষ্যতে এরকম করতে চাইলে তাতে প্রতিবাদ খুব একটা আশা করা যায় না।দেখা গেলো, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট আদায় করতে ব্রজমোহন নামের পরিবর্তে চরমোনাইর পীর ‘ফজলুল করিম’-এর নাম জুড়ে দিয়েছে, যেরকমটা ঘটেছে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর নামের ক্ষেত্রে; দেশে এতো এতো বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক থাকতে বিমানবন্দরগুলোর নাম কিনা শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ আমানত, ইত্যাদি……..হা হা হা হা হা।

কিছুদিন আগে খালেদা জিয়ার ‘গোপালগঞ্জের নামই পরিবর্তন করে দিবো’ ভিডিওটি নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেছেন। কিন্তু এটা যে কেবল তার রাগের প্রকাশ এটা ভাবলে ভুল করবেন। গোপালগঞ্জের মাটিতেই গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করার দাবি এর আগে একবার করা হয়েছিলো এক মাহফিলের বয়ানে। তার যুক্তি ছিলো, গোপাল কৃষ্ণের আরেক নাম, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে কোন জেলার নাম গোপালগঞ্জ হতে পারে না। খালেদা জিয়ার গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করতে চাওয়া যে মুসলিম-মানসের প্রতিফলন, তা বুঝতে খুব গভীরে যেতে হয় না। জয়দেবপুর যে এখন গাজীপুর, তা তো আপনারা দেখতেই পান। এরকম অগণিত উদাহরণ পাবেন আপনার আশেপাশেই।

গোপালগঞ্জের সরকারী বালক ও বালিকা বিদ্যালয় দুটির নাম যথাক্রমে সীতানাথ-মথুরানাথ (এস.এম) মডেল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় এবং বীণাপানি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। বালক বিদ্যালয়টি এস.এম মডেল স্কুল নামেই পরিচিত। স্কুলটির এক প্রধানশিক্ষক যখন স্থায়ী গেটে পুরো নামটি ‘সীতানাথ-মথুরানাথ মডেল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়’ খোদাই করে দিয়েছিলেন, তখন দুই প্রভাবশালী হুজুর তাঁর বাসায় গিয়ে দাবি করেছিলো যেন হিন্দু নাম দুটি মুছে প্রতিষ্ঠাতাদের নামের আদি অক্ষর বসিয়ে এস.এম করে দেয়া হয়। তাদের কথা ছিলো, সীতানাথ-মথুরানাথ নামটি দিয়ে স্কুলটিকে হিন্দুয়ানি করে ফেলা হয়েছে, এস.এম থাকলে অন্তত হিন্দুয়ানি গন্ধ আসবে না। কী আবদার! তারা কেবল দাবীই করে নি, হুমকিও দিয়েছিলো।

গোপালগঞ্জেরই আরেকটা খুবই সাম্প্রতিক বিষয় না জানিয়ে পারছি না। পূবালী ব্যাংক গোপালগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দেড় বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকেই লিখছি। মূলতঃ বিদেশে চলে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি ওখানেই ছিলাম। গোপালগঞ্জে আমি সাহা পাড়ায় থাকতাম, পূবালী ব্যাংকটিও সাহা পাড়ার পাশেই অবস্থিত। ঐ সাহা পাড়ায় ২০১৩ সালে ‘রাবেট’ নামে একটি ছেলে তার বাসার সামনেই খুন হয়। রাবেট প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং তাকে যারা খুন করেছিলো তারা সবাই হিন্দু পরিবারের। দুর্গা পূজার কোন একটি ঘটনার ভুল বুঝাবুঝি থেকেই খুনটি হয়। সে যাই হোক, খুনীরা শাস্তি পাক, এটা সবারই চাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপের জন্য কোন দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি না হলেও এই খুনটিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে নীরব হিন্দু নির্যাতন চলছে। রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব বিস্তার না করলেও গোপালগঞ্জের বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ীই হিন্দু। রাবেটের খুনের পরে এসব ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের নীরব নির্যাতন চলছে। কেউই বাংলাদেশে নিরাপদ বোধ করছে না। বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ীই তাদের ব্যবসা গুটানোর চিন্তায় আছে। আমি অনেককেই দেখেছি, ব্যাংক থেকে এফ.ডি.আর তুলে নিয়ে ভারতে জমি কিনতে বা ভারতে ব্যবসা গোছানোর চিন্তায় আছে; অনেকেই ইতোমধ্যে তা করে ফেলেছেন। অথচ ২০১৩ সালের আগে গোপালগঞ্জের হিন্দুরা নিজেদের খুবই নিরাপদ বোধ করতেন এবং ভারতে যাওয়ার কথা খুব কমজনই চিন্তা করতেন। আর কয়েক বছরের মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলা শহর হিন্দুশূণ্য দেখলে আশ্চর্য হওয়ার থাকবে না।

বরিশালের ‘অমৃতলাল দে’ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অমৃতলাল দে পরিবার এখনো বরিশালে টিকে আছে, কিন্তু তাদেরকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে যে-পরিমাণ চাঁদা দিতে হয়, তা রীতিমত আতঙ্কের। এভাবে কতোদিন তারা আপোষ করে টিকে থাকতে পারবেন? যেখানেই প্রভাশালী হিন্দুরা আছেন, তারা এভাবে আপোষ করেই টিকে আছেন।

দেশকে ইসলামাইজেশনের মাধ্যমে হিন্দু নামকরণ মুছে ফেলার মুসলিম-মানসিকতাকে হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তার জন্যেই তাকে মৌলবাদীদের হাতে রক্তাক্ত হতে হয়েছিলো।

সম্প্রতি এফডিসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযুষ বন্দোপাধ্যায়কে দুর্নীতির দায়ে ধরা হয়েছে। কিন্তু আপনি কি মনে করেন, সাড়ে তিন কোটি টাকার সরকারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে পুরাতন মালামাল ক্রয়ের সাহস তার মতো একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক করতে পারেন? ভিতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন, এর কলকাঠি নেড়েছে উর্ধতন কোন মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কাছের কোন জন; তার হয়তো কিছু করারই ছিলো না। এখন তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। একে একে সকল নেতৃস্থানীয় হিন্দুদের এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ মাথা তুলতে সাহস না পায়। ওলামা লীগের ৯৮% মুসলমানের দেশ প্রতিষ্ঠিত করতে এর বিকল্প নেই যে।

বাংলাদেশের হিন্দুঃ একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি (পর্ব-২)

Leave a Comment