ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল-এর বাংলাদেশে বর্তমানে মোট অনুমোদিত ব্যাংকের সংখ্যা ৫৫ টি। এর মধ্যে রয়েছে ৩৮ টি বেসরকারী ব্যাংক, বিদেশী বানিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ১০ টি এবং গ্রামীণ ব্যাংকসহ সরকারী বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে ৯ টি। এছাড়া ব্র্যাক-আশাসহ কিছু এনজিও, সমবায় অধিদপ্তর থেকে অনুমোদিত বিভিন্ন কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা মাল্টিপারপাস ও খাই-খাই প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিসহ বিভিন্ন অনুমোদিত ও অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানও আমানত সংগ্রহ, ঋণপ্রদানসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
আয়তন অনুপাতে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা খুবই বেশি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সাথে ব্যাংক বাদেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এক অসুস্থ প্রতিযোগীতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রতিযোগীতা সবসময়েই নতুন কিছুর জন্ম দেয়, তাই প্রতিযোগীতাকে স্বাগতমই জানানোর কথা। কিন্তু সে প্রতিযোগীতা অসুস্থ হলে তা ভাল কিছুর সৃষ্টি না করে মন্দের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগীতার জন্য আমানত সংগ্রহের জন্য প্রতিযোগীতামূলক সুদ রেট বিদ্যমান। ২০১১ সালের শুরু থেকে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগীতা এত অসুস্থতায় টান নিয়েছিল যে কিছু বেসরকারী ব্যাংক স্থায়ী আমানতের সুদহার ১৪-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলেছিল। পরবর্তীতে BAB (Bangladesh Association of Banks, বেসরকারী বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা) সিদ্ধান্ত নেয় ১২.৫ শতাংশের বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ না করার। কিন্তু এরপরও কোন কোন ব্যাংক গোপণে ১২.৫ শতাংশের বেশি সুদ দিয়ে আমানত নিয়েছিলো। আমানত সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন উপঢৌকন থেকে ঘুষ প্রদান এখন অনেকটা খোলামেলা বিষয়। যদিও বর্তমানে ঋণ কমে যাওয়ায় আমানত সংগ্রহের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতাটা নেই বললেই চলে, তবুও কিছু কিছু চলে।
আমানত সংগ্রহে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলেও ঋণের সুদ কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মধ্যে কোন প্রতিযোগীতা নেই। এক্ষেত্রে আরো উল্টো প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কিছু কিছু ব্যাংকে ঋণ নেয়ার শর্ত কিছুটা শিথিল থাকে, ঋণ প্রসেসিং কিছুটা দ্রুত হয়, কিন্তু একইসাথে তাদের ঋণসুদ অনেক বেশি। বর্তমানে কিছু বাধ্যতামূলক কৃষি ঋণ এবং মহিলা উদ্যোক্তার এস.এম.ই ঋণ বাদ দিলে অন্য ঋণের সুদহার ১৬-২০ শতাংশ। কিছু ব্যাংকের আবার এক শতাংশ সার্ভিস চার্জ রয়েছে। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে কোন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করা আদৌ সম্ভব হওয়ার কথা না, কিন্তু কিছু কিছু উদ্যোক্তা এরপরও ঋণ নিচ্ছেন এবং শিল্প প্রতিষ্ঠা করছেন। তাদের শিল্প কতটুকু লাভের মুখ দেখে এটা একটা প্রশ্ন বটে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় তারা ঋণের সুদও দিচ্ছেন এবং খেলাপীও হচ্ছেন না, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব উদ্যোক্তারা প্রতিবছর ঋণের পরিমান ক্রমাগত বাড়াতে থাকে, একই ব্যাংক যদি বাড়াতে অসম্মতি জানায় তখন আরেক ব্যাংক থেকে বাড়িয়ে নিয়ে তারা তাদের ব্যবসায়িক মূলধন ঠিক রাখে এবং ব্যাংক সুদও প্রদান করে থাকে। একে মাছের তেলে মাছ ভাজা বলা যেতে পারে। ব্যাংকগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ কেনার ব্যাপারে আরো বেশি প্রকট; কোন ঋণ কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেকসময়ই ঐ কোম্পানিটি কতটা রুগ্ন তা ভাবে না। রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেনার ক্ষেত্রে সরকারী ব্যাংকগুলো বেসরকারী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে। ঋণেকে শ্রেণিকরণের হাত থেকে বাঁচাতে ব্যাংকগুলো রুগ্ন ঋণকে আরো বাড়িয়ে দেয়, বারবার রিশিডিউলিং করে; অনেকক্ষেত্রেই ঋণের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না। এ প্রবণতা প্রায় সব ব্যাংকগুলোতেই দেখা যায়।
এতো গেলো আমানত আর ঋণ। সবচেয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে কে কতো বেশি লাভ করতে পারে, তা নিয়ে। প্রতি বছর প্রফিট টার্গেট ৪০% থেকে ৭০% বাড়িয়ে দিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেব করতে থাকে কোন খাত দিয়ে লাভ বাড়ানো যায়। অনেক সময়ই লাভ বাড়াতে গিয়ে গ্রাহকদের হিসাব থেকে বিভিন্নভাবে কর্তন চলতে থাকে। ব্র্যাক ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংক যে কতো বিচিত্র বিষয়েই চার্জ কর্তন করে তা হিসাব বিবরণী তুলে চেক করলে দেখা যায়। এছাড়া ষান্মাসিক ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের কর্তন তো আছেই।
একটা অদ্ভুত ঘটনা বলি। ২০০৯ বা ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এরকম একটা সার্কুলার ইস্যু করলো, “অনেক ব্যাংকের নামেই অভিযোগ আসছে যে, তারা অত্যাধিক হারে ষান্মাসিক এ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স ফি কর্তন করে থাকে। সুতরাং এখন থেকে কোন ব্যাংক কোন গ্রাহকের হিসাব থেকে ষান্মাষিক এ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স ফি সঞ্চয়ী হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা এবং এবং চলতি ও এস.এন.ডি হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা কর্তন করতে পারবে।”
মজার ব্যাপার হলো, ঐ সময়ে দু’একটি ব্যাংক হয় তো এতোটা চার্জ কর্তন করতো। বাকিরা ৫০ থেকে ২০০ টাকা।। ঐ সার্কুলারের পরে প্রায় সব ব্যাংকই এ্যাকাউন্ট মেইনটেন্যান্স ফি বাবদ সঞ্চয়ী হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা এবং এবং চলতি ও এস.এন.ডি হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা কর্তন করা শুরু করলো। এসময়ে আমরা যারা ব্যাংক কর্মকর্তা তারা খুবই অসহায় বোধ করতাম। বিশেষ করে যখন একটা গরীব লোক ডিসেম্বরে বা জুনে হিসাবে অল্প কিছু টাকা রেখে যেতো এবং জানুয়ারি বা জুনে এসে দেখতো যে, টাকা নাই বা থাকলেও খুবই কম আছে, তখন সেই লোকটার অসহায় মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হতো। তবুও অনেকটা মিথ্যে বলতে হতো বা এখনো ব্যাংক কর্মকর্তাদের মিথ্যে বলতে হয় যে, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার; আমরা কী করবো!
পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটা সার্কুলার ইস্যু করে যে, যাদের হিসাবে মাসিক গড় স্থিতি ৫০০০ টাকার নিচে, তাদের কোন চার্জ কর্তন করা যাবে না; যাদের ২৫০০০ পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ ১০০ টাকা কাটতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারও ঠিকমতো পালন করা হয় না। গড় স্থিতিটাকে গড় না ধরে, ছয় মাসের যে কোন দিনে সর্বোচ্চ স্থিতি ধরে চার্জ কাটা হয়। গ্রাহকদের ভুং ভাং বুঝানো ছাড়া কর্মকর্তাদের কিছু করার থাকে না।
এছাড়া আরো রয়েছে, অনলাইন সার্ভিস চার্জ। অনেক ব্যাংকই অনলাইন সার্ভিস চার্জ নেয় না এমন বলে থাকে। কিন্তু তারাও ষান্মাসিক ভিত্তিতে চার্জ কর্তন করে। তখন যে ব্যক্তি ছয় মাসে দশ কোটি টাকা অনলাইন পাঠিয়েছে, তারও যে পরিমাণ কর্তন করা হয় এবং যে ব্যক্তি আদৌ অনলাইন করে নি, তারও সমপরিমাণ কর্তন করা হয়। তেলে মাথায় তেল দেয়া আর কী!
আমার চাকুরী জীবনে এরকম অনেক খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। একবার এক গ্রাহকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। গ্রাহক মহিলা এবং খুবই গরীব। অন্যের বাড়িতে রান্না-বান্না, থালা-বাসন ধোয়া ইত্যাদি কাজ করেন। তিনি মাসে-দুই মাসে বা যখন পারেন ১০০, ২০০ বা ৩০০ এরকম টাকা জমা দিতেন। প্রায় ৫ বছর এভাবে টাকা জমা করে একদিন ব্যাংকে এসেছেন কোন একটা জরুরী প্রয়োজনে টাকা তুলতে। ওনার কাছে হিসাব আছে যে, উনি কতো টাকা জমা করেছেন। তিনি এসে দেখেন, তার হিসাবের থেকে অনেক টাকা কম। আমরা ব্যাংক বিভিন্ন চার্জ বাবদ তাঁর হিসাবের অনেক টাকা কেটে ফেলেছি। তিনি যখন আমার সামনে এসে কান্না করে দিয়েছিলেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপক হিসেবে তখন নিজেকে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি মনে হয়েছিলো। এরকম ঘটনায় প্রায়শই আমি নিজের পকেট থেকে কিছু দিয়ে বা অন্য কোন খরচের খাত থেকে টাকা এনে পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু বেশিরভাগদেরই ভুগি-জুগি বুঝিয়ে দেয়া হতো।
আরেকটি বিষয় আছে বেশ প্রতারণার মতো। কোন কোন ব্যাংক বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেয় যে, ডিপিএস জাতীয় কোন হিসাব খুলতে হলে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে হবে। সঞ্চয়ী হিসাবটা এজন্যই খুলতে বাধ্য করছে যে, ওটা দিয়ে তারা একটা ষান্মাসিক চার্জ কর্তন করতে পারবে। সোজা কথায়, লাভ বৃদ্ধি।
যাই হোক, শেষ কথায় আসি। ব্যাংক একটা মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান। সঞ্চয়কারীর কাছ থেকে আমানত নিয়ে বিনিয়োগকারীকে ঋণ প্রদান করে, একটি ব্যাংকের ঋণের পরিমাণের তুলনায় পেইড আপ ক্যাপিটাল খুবই সামান্য। সুতরাং মানুষের টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে হলে লাভের পরিমাণেরও একটা নৈতিকতা থাকা দরকার। বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশে একটা ব্যাংক ৫০০-৭০০-১০০০-২০০০ কোটি টাকা লাভ করা ঘৃণ্যরকমভাবে অনৈতিক। কোন কোন ব্যাংক কর্পোরেট সোশ্যাল রেন্সপন্সিবিলিটি (CSR)-এর নামে বেশ ব্যয়-ট্যয় করে থাকে। একইসাথে মার্কেটিং ও মানবতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে আবির্ভূত হয় তারা। এর চেয়ে বরং ঋণের সুদহার কমিয়ে দেশের শিল্প-কারখানার রুগ্নতা প্রতিরোধ করা গেলে বেকার সমস্যা সমাধান অনেক ভাল উদ্যোগ বলে মনে করি।
আব্বা ইসলামিক ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল।যেটা প্রায় আট বছর পর আমাদের মফস্বল শহরের একটা জমি ১৮লাখ টাকা শতাংশ করে বিক্রি করে পরিশোধ করতে হয়েছে।
তখন আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কোন ব্যবসাতেই টেকা যাবে না।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার এতো বেশি যে, তা নিয়ে ব্যবসা করে কতোটা লাভ করা যায় তা গবেষণা করে দেখা দরকার। তবে বড় ব্যবসায়ীরা যা করে তা হলো, ঋণগুলো ক্রমাগত বড় করে এবং করতেই থাকে। কইয়ের তেলে কই ভাজা। আর ছোট ব্যবসায়ীরা শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করে।
দয়া করে প্রতিযোগিতা শব্দটির বানান সংশোধন করুন। শিরোনাম সহ সর্বত্র ভুল বানানে রয়েছে শব্দটি। প্রতিযোগী বিশেষ্য, প্রতিযোগিতা বিশেষণ, লক্ষ্য করুন বানানের ভিন্নতা। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। ঠিক করে দিলাম।