ছোটগল্পঃ আবহমান

দ্রুতবেগে ফেরিটাকে আসতে দেখেও সেরজন আলী নৌকাটাকে সামনে চালিয়ে দেয়। ফেরীতে পার হওয়া যাত্রীরা ভয়ে আতকে ওঠে, এই বুঝি নৌকাটা ফেরীর নিচে পড়ে গুড়িয়ে যায়। সেরজন আলীর কোন তাড়া নেই, ফেরীর নিচে পড়লেও যেন কিছু যায় আসেনা এমন ভাবেই সে বৈঠা বেয়ে এগিয়ে যায়। ফেরির সাথে ধাক্কা লাগার পূর্বেই সেরজন আলী নৌকাটিকে ফেরীর পাশ কাটিয়ে সরিয়ে নেয়। ফেরীর চালক রহমান খলিফাও জানে সেরজন আলীদের গতি ও দূরত্বের হিসেব নিউটনের চেয়ে কম হলেও কার্গো-জাহাজের মাস্টারদের চেয়ে মোটেও কম নয়। ফেরীর যাত্রীদের মাঝে একটু উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়াই যেন এর উদ্দেশ্য।

ফেরী চালকরা বড় কার্গো কিংবা জাহাজ দেখলে দূর থেকেই হর্ণ দেয়, কিন্তু এরকম ছোট নৌকাগুলো নিয়ে তাদেরও যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। অতিশয় মানবতাবাদী কেউ হয়তো ভাববে এ বুঝি গরীবের প্রতি উদাসীনতা।

নৌকার যাত্রী সেরজন আলী একা নয়। তার চার-চারটি সন্তান, যাদের সবচেয়ে বড়টির বয়স দশ-এগার হবে এবং সবচেয়ে ছোটটির বয়স দেড় বছর। এছাড়াও রয়েছে হালিমা- সেরজনের স্ত্রী। এরা আসলে নৌকার যাত্রী নয়, নৌকার বাসিন্দা। যে কীর্তনখোলা তাদের ভিটে-মাটি সব বক্ষে ধারণ করেছে, সে কীর্তনখোলার বক্ষেই তারা খুঁজে নিয়েছে আশ্রয়।

জালের নিচের পাটি টানতে টানতে হালিমা প্রশ্ন করে, “আন্নের কী মনে অয়, কুতুব আলি হেদিন যা কইল হেয়া কি হাচা?”
“কুতুইব্বা আবার কী কইল? হের লগে তোর কতা অইল কবে?”
“হেদিন আন্নে যহন মাছ লইয়া গদিতে গ্যালেন, কুতুব আলী কইল হে পেপারে পড়ছে দপদইপ্পা ব্রিজ অইয়া গ্যালে নাহি এই নদী চর পইর‌্যা ভইর‌্যা যাইবে।”

কীর্তনখোলার চর পড়ে ভরে যাওয়া নিয়ে সেরজনের কোন কৌতুহল থাকে না। বরং সে মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখে কীর্তনখোলা চর পড়ে ভরে গিয়েছে এবং সেরজন আলী তার বাপের ভিটেবাড়ী আবার ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সেরজন জানে সে হবার নয়। নদীতে নতুন যত চরই জাগুক, সে চলে যাবে অপসোনিন কিংবা খান সন্সের মত ভূ-দস্যুদের হাতে। কুতুব আলীর ব্যাপারটাই তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, “আমি নৌকায় না থাকলেই বুঝি কুতুইব্বার লগে গাল-গপ্পো মারো। মাগি, জাল টানতেছ, টান। কুতুইব্বার লগে পিরিত মারাইয়া লাভ নাই। হের দুইডা বউ আছে, হেইগুলাই না খাইয়া মরে হুনছি।”

স্বামীর কথার ধরণে দমে যায় হালিমা। শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে জাল টানতে থাকে। নিচের পাটিটা টানতে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়। প্রথমদিকে সে উপরের পাটিটাই টানত, নিচেরটা টানত সেরজন আলী। হালিমার পেটে যখন চার নম্বর সন্তান আসে তখন সেরজন আলি তাকে নিচের পাটি টানার জন্য নির্ধারিত করে দেয়। হালিমা প্রতিবাদ করেছিল। কোন কাজে আসেনি। সেরজন আলীর যুক্তির কাছে হালিমার প্রতিবাদ ধোপে টেকেনি। “মাগি, বছর বছর যে হারে বিয়োনো শুরু করছো তাতে এই নৌকায় তো ধরবে না। তোর মাইয়া পোলা পালনের লইগ্যা আর একখান নৌকা লাগবে। জাল টাইন্যা শরীল কোমাইলে যদি তোর বিয়ানো কোমে আর যেডা তোর প্যাডে আইছে হেডা পইর‌্যা গ্যালেও ভালো।”

হালিমার চার নম্বর সন্তান পেট থেকে জীবিতই পড়েছিল। তবে ছয় মাস বয়সে জলে পড়ে গিয়েছিল। হালিমার ধারণা ফাতেমাকে সেরজন আলীই জলে ফেলে দিয়েছে। একটা ছয় মাসের মেয়ে কিছুতেই নিজে গিয়ে জলে পড়তে পারে না। সেদিন হালিমা ছোট ছেলে আর মেয়েকে বাবার কাছে রেখে বড় ছেলেটাকে নিয়ে কাঠ কুড়াতে গিয়েছিল। ফিরে এসে ফাতিমাকে আর পায়নি।

এরপরেও হালিমা আরো একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিল। সেটারও একই পরিণতি, মৃত্যু। হাচিনার মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সে। নিজেকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারেনা সে।

সেদিন সারাদিন খুব মাছ পড়েছিল। সারাদিনই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, সন্ধ্যের পর থেকেই শুরু হয়েছিল মুসলধারে বৃষ্টি। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছিল সন্ধ্যে হতেই। সারাদিনের ভেজা শরীরে একটু শীত শীত লাগছিল। সেরজন আলী মাছ বিক্রি করে নৌকায় ফিরতেই হালিমা বুঝতে পারছিল সে মদ খেয়ে ফিরেছে। যখন বেশি মাছ পড়ে তখন সেরজন আলী এরকম প্রায়ই খেয়ে আসে। হালিমাও কিছু মনে করে না। কিংবা কিছু মনে করার অধিকার নিয়েই সে জন্মায়নি।

রাতের খাওয়ার পরে সেরজন তাকে টেনে কোলের মধ্যে বসিয়ে আদর করতে থাকল। বিয়ের কয়েক মাস পর থেকে যে স্তন সেরজন আলী ছুঁয়েই দেখেনি, সেটাই যেন আজ বড় খেলার সামগ্রী হয়ে গেছে। হালিমাও বেশ উপভোগ করছিল স্বামীর আদর। আদর করতেই করতেই সেরজন কোমরে গোঁজা বিড়ির প্যাকেটটা বের করে। একটা বিড়ি ধরিয়ে হালিমার দিকে এগিয়ে দেয়-“নে, দুইডা টান দে।”

অনেকদিন পরে স্বামীর এই মাতাল আদর এবং আদর করে বিড়ি টানতে দেয়া তার খুব ভাল লাগে। কয়েকটান দিয়েই হালিমা বুঝতে পারে এ সাধারণ বিড়ি নয়। তারপর আরো একটা বিড়ি দু’জনে মিলে টানতে থাকে। বিড়ি টানা শেষে সেরজন তাকে কোন এক স্বর্গের দেশে নিয়ে যায়। হালিমা আর কিছু মনে করতে পারেনা। যখন সে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পৌঁছে তখন সকাল। বড় ছেলে তাকে ডেকে তোলে। হালিমা জেগে দেখে তার বালিশের তলায় চ্যাপ্টা হয়ে আছে হাচিনার মুখ।

হালিমা কাঁদতে পারে নি সেদিন। বুকটা পাথর হয়ে ছিলো। নিজের হাতেই নিজের কন্যাকে খুন! আল্লাহ তাকে কী শাস্তি দেবে? ভাবনাকে সরিয়ে দেয় হালিমা। যে আল্লাহ তাদের জমি নিয়েছে, নদীতে বাস করতে বাধ্য করছে, সে-আল্লাহ কী শাস্তি দেবে না দেবে তাতে হালিমার কিছু যায় আসে না। আর এই হাচিনার জান কি আল্লাহর ফেরেশতা কবজ করে নি? আল্লাহর হুমুক ছাড়া তো হবার কথা না। তাহলে সে-আল্লাহর ভয়ের কোন মানে খুঁজে পায় না হালিমা।

সন্তানের মৃত্যু নিয়ে সেরজন আলীর যেন কোন ভাবনাই নেই; মেয়েটার মৃত্যুতে সে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। যে-মেয়ে বড় হয়ে তার কেবল দুর্ভোগই বাড়াবে, তা বেঁচে থাকলো আর না থাকলো তাতে কী এসে যায়! হালিমা চেয়েছিলো হাচিনাকে কূলে তুলে মাটিতে কবর দিতে। সেরজন আলী ধমক দেয়, “কূলে কি মোগো মাডি আছে যে, হেইহানে কবোর দিবি? সব তো গাঙে খাইছে।“ হালিমার সাথে সাথে কথা বলতে বলতে হাচিনাকে ধরে জলে নিক্ষেপ করে। কীর্তনখোলার ভাটার টানে হাচিনার মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে সুগন্ধা জলে টেনে নিয়ে যায়। যতক্ষণ হাচিনার মৃতদেহ দেখা যায়, হালিমা-সেরজন দুজনই সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সেরজন আলীর যেন খুব খিদে পায়- “দুইডা মরিচ পোড়, পান্তা খাইয়া রেডি অওয়া লাগে; জোয়ার আওয়ার আগেই জাল ফালান লাগবে।“ হালিমাও সম্বিত ফিরে পায়। আগুনের তাওয়াটা টেনে মরিচ পুড়তে লেগে যায় সে।

এভাবেই চলতে থাকে সেরজন আলী ও হালিমার সংসার। কীর্তনখোলায় ইতোমধ্যে ব্রিজ হয়ে গিয়েছে। ফেরি সার্ভিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই নদীর ওপর দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। যেতে যেতে জানালায় তাকালে এখনো সেরজন আলীর ক্ষুদ্র নৌকাটা হয় তো দেখা যায়, তবে ওদের জীবনকে উপলব্ধি করার সুযোগ হয় না কারো।

6 Comments

  1. নিভৃতচারী
  2. Ranjit Paul
  3. Abdullah Al-Mamun

Leave a Comment