নাস্তিকতা, ইউরোপ, পাকা পায়খানা এবং

গতকালও আমার ফেসবুকে পোস্টে একজন মন্তব্য করেছে যে, ইউরোপে আসার জন্যই নাকি আমার নাস্তিকতা নিয়ে লেখালেখি। অনেকেই আকারে-ইঙ্গিতে এমনটা মিন করে থাকে। তাদেরকে জবাব দেবার জন্যই এই পোস্ট।

বাংলাদেশে আমি অন্তত অতোটা গরীব ছিলাম না যে, আমাকে নাস্তিকতা নিয়ে লিখে ইউরোপে আশ্রয় নিতে হবে। আমি একটা বেসরকারী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার কাম ব্যবস্থাপক ছিলাম। সর্বশেষ ছিলাম গোপালগঞ্জ জেলা শাখার ব্যবস্থাপক। চাকুরিজীবনে আমার সাফল্য আকর্ষণীয়ই ছিলো। আমি চাকুরী ছাড়ার দরখাস্ত দিলে আমার বস (উপমহাব্যবস্থাপক) বলেছিলেন, “রতন বাবু, একটা সাজানো বাগান রেখে যাচ্ছেন।”

২০০৮ সাল থেকে আমি ব্যাংকে ছিলাম। চাকুরীতে ঢোকার পর থেকেই যেভাবে আগাচ্ছিলাম তাতে ব্যাংকের জিএম পর্যন্ত যাওয়া আমার জন্য তেমন কঠিন হতো না। গাড়ি-বাড়িও হতো নিঃসন্দেহে। ছেলেমেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে পড়ানোও সমস্যা হতো না সম্ভবত।

আমার স্ত্রী ছিলেন একজন সরকারী চাকুরিজীবি। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চাকুরীতে তার ৯ বছরের অভিজ্ঞতা। কত স্বপ্ন ছিলো! জুলাইয়ে নতুন বেতন স্কেল দিবে সরকার, বেসরকারী হলেও আমার বেতনও বাড়বে। নতুন কিছু পরিকল্পনা করবো।

দুটো চাকুরী ছাড়াও আমাদের যা ছেড়ে আসতে হয়েছে তার তালিকাঃ
১. আমার চাকুরীর বয়স আগামী এপ্রিলে ৮ বছর হতো। এটুকু সময়ও যদি থেকে আসতে পারতাম, তবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ফুল পেতে পারতাম। আমি নিজের ২০% + ব্যাংকের ১০% এবং সুদ মিলে এখন ৬ লাখের মতো জমা হয়েছিলো সম্ভবত। আট বছর হলে গ্রাচুয়িটিও পেতাম। চাকুরী ছাড়ার জন্য তিন মাসের বেসিক জমা দিতে হয়েছে ৮২০০০/- টাকা এবং একটা বোনাস নিজের হাতে পাস করে ডিস্ট্রিবিউট করলেও নিজে নিতে পারি নি, কারণ তখন আমার রেজিগনেশন এ্যাকসেপ্ট হয়ে গিয়েছে। রেসিগনেশন এ্যাকসেপ্ট হলেও পুরো কাজ সমাপ্ত করে আসতে পারি নি। আমার নিজের বেতন থেকে কাটা ৪ লাখ টাকাও যে পাবো, এমন কোন আশা দেখছি না।

২. বউয়ের চাকুরীর বয়স আগামী জুলাইয়ে ১০ বছর পূর্ণ হতো। তখন ছাড়লে সে বেশ বড় অংকের একটা টাকা পেতো। এখন হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাবে শুনেছে, তবে তাও আদৌ পাবে কিনা কে জানে।

৩. ধার দেয়া টাকাও আছে লাখ খানেকের ওপরে। জমি কেনার জন্য বায়না করা আছে ৯০০০০/-, বউ ভিন্নভাবে চেষ্টা করছে তা উদ্ধারের।

৪. এতো বছর ধরে সুখে-দুঃখে-কষ্টে তিল তিল করে গড়া সংসারের আসবাবপত্র। খাট-টেবিল-চেয়ার-টিভি-ফ্রিজ আলমারী-ওয়ার্ডরোব-সোফা-ওভেন, ইত্যাদি বাদেও যার মধ্যে রয়েছে নির্ঝরের জন্য কেনা একটা কম্পিউটার ও একটা সাইকেল। যে দুটো ওকে আবার কবে কিনে দিতে পারবো জানি না। এখানে আসার পর থেকেই নির্ঝর সাইকেল সাইকেল করছে। কিনে দিতে না-পারার কষ্টটা আপনারা বুঝবেন না।

৫. সবই হয় তো একদিন হবে। কিন্তু ফেলে আসা সময়টাকে আর কেউ দিতে পারবে না। একসময় আমি একটা অফিসের বস ছিলাম, যদি এখানে চাকুরীও করি, কী এমন চাকুরী করবো? অর্থ হয় তো আসবে, সম্মান কই?

৬. আপনারা যারা পাকা পায়খানার কথা বলেন তাদের জন্য এই প্যারাটা। আমি সত্যিই দেশের পাকা পায়খানা মিস করি। এখানে আমার জন্য দেয়া বাসায় একটা মাত্র টয়লেট, তাও এতো ঘিঞ্জি যে ওখানে ঢুকলেই আমার সবচেয়ে বেশি দেশের জন্য মন কাঁদে। স্নান করতে গেলে মোড় ফেরা যায় না।

৭. দেশের মানুষ আর প্রকৃতিকে যে ফেলে এসেছি, এ কথা বললে তো বলবেন, এসব আদিখেত্যা।

যা হোক, আপনাদের অপবাদ নিয়ে অতোটা মাথা ঘামাই না। তবুও লিখলাম, কারণ এমন অপবাদ কমবে না এবং যতবার আপনারা বলবেন, ততবার আমি আপনাদের বুঝাতে বিরক্তি লাগবে; এখন থেকে লিংক ধরিয়ে দিবো।

শেষ কথা, আসিফ মহিউদ্দীন দেশ ছাড়ার পরে যারা যারা তার সমালোচনা করেছিলেন, এখন তাদের অনেকেও দেশ ছাড়ার চিন্তা করছেন। কদিন পরে লাইনটা যে আরো দীর্ঘ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই একটা অনুরোধ করছি, সমালোচনা করলেও ব্লক কইরেন না, পরে আমিও আপনার কাজে লাগতে পারি।

10 Comments

  1. Shagor Biswas
  2. Bayazid
  3. Neon Seven

Leave a Comment