রুমার চোখের জলের লবনাক্ত স্বাদ

রুমাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য! একসময় ওকে ভোলার জন্য কতো চেষ্টা করেছি! ওর চোখের জলের নোনতা স্বাদটুকু জিহ্বা থেকে সরানোর কতো চেষ্টা করেছি! তবুও সারাটা দিন, সারাটা ক্ষণ রুমা আমাকে তাড়া করতো। একসময় হতাশা ভর করেছিলো আমাকে। হতাশা থেকেই হয় তো ওকে ভুলে গেলাম একদিন। তারপরও দু-চারদিন মনে পড়লেও মন থেকে ইচ্ছা করে তাড়িয়ে দিতাম।

আজ ফেসবুকে ঢুকেই দেখি, সালমা রুমা নামে একজন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। নামটা পড়ার সাথে সাথেই আমার মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো। আমি তার প্রোফাইলে গেলাম। ছবি দেখলাম। ছবি মিললো না। তবুও আমি নিজেকে বোঝাতে চাইলাম যে, আমার স্মৃতি আমাকে ফাঁকি দিতে পারে। দীর্ঘ একটা মেসেজ দিলাম। তার উত্তরে যা পেলাম, তাতে বুঝলাম এ আমার কাঙ্খিত রুমা নয়। বাংলায়, ইংরেজীতে যতোভাবে সম্ভব ‘সালমা রুমা’ লিখে সার্চ দিলাম। দীর্ঘক্ষণ ঘাটাঘাটি করেও পেলাম না। কে জানে, রুমাও হয় তো আমার মতোই একটা ভূতুড়ে নামে ফেসবুকিং করে; আবার জীবনের পথে কোথাও হোচট খেয়ে হারিয়েও যেতে পারে; জীবনকে টেনে টেনে বয়ে বেড়ানোকে গুরুত্বহীনও বিবেচিত হতে পারে তার কাছে। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র তো ওকে হারিয়ে যাওয়ার পথই নির্ধারিত করে দিয়েছিলো।

প্রায় চার বছর হতে চললো রুমার সাথে প্রথম ও শেষ দেখা হয়েছিলো। অফিসের এক ট্রেনিংয়ের জন্য আমি সুরভী-৭ লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম। নভেম্বরের প্রথম দিকে। রুমের মধ্যে বেশ কয়েকটা সিগারেট টানার ফলে রুমটা ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং কেমন গরম অনুভূত হওয়ায় রাত বারোটার দিকে আমি কেবিন থেকে বের হয়ে সামনের চেয়ারে বসে নদীতে জেলেদের নৌকার বাতি আর পাশ থেকে আমাদের সমান্তরালে চলা আরেকটা লঞ্চ দেখছিলাম এবং সিগারেট টানছিলাম। রুমা পাশের রুমের সামনের ব্যালকনিতে বসে আকাশ দেখছিলো। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিলো না, সমস্ত আকাশজুড়ে তারার মেলা। আমি দ্বিতীয় সিগারেটটা জ্বালতেই রুমা প্রশ্ন করলো, “আপনি খুব বেশি সিগারেট খান। গত এক ঘণ্টায় আপনি চারটা সিগারেট টেনে এখন পঞ্চমটা ধরেছেন।“

পাশে রেলিং ধরে দাঁড়ানো একটি নারী দেখেছিলাম, কিন্তু সে যে আমাকে কিছু বলবে এটা ভাবি নি। আর রুমে বসেও যে আমি সিগারেট টানছিলাম, তাও যে সে খেয়াল করছিলো, এটা তো ভাবিই নি। রুমার কথায় প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। একটু ভেবে বললাম, “আপনার তারা দেখায় ব্যাঘাত ঘটালাম কি?”

“আরে না! আমি তারা টারা দেখছিলাম না। ওসব কবিদের রোগ, শহুরেদের বিলাস।“ রুমাকে কথায় বেশ সপ্রতিভ মনে হলো।

“তাহলে কি নদীর বিশালতা অনুভব করছিলেন?” আমার ফের প্রশ্ন।

“আপনি মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বেরুতে পারবেন না জানি। মানুষ তো জোর করে অন্যের অভিজ্ঞতাকে অনুভব করতে পারে না। সুতরাং ও প্রচেষ্টা আজ বাদ থাকুক।“

আমাদের কথা এগুচ্ছিলো এভাবে। যদিও আমার প্রধান ভূমিকা ছিলো শ্রোতা হিসেবেই। বন্ধুদের আড্ডাবাজিতে আমার বদনাম আছে যে, আমি নাকি একাই কথা বলতে চাই। কিন্তু রুমার সপ্রতিভতায় আমি কেবল শ্রোতা হয়েই রইলাম সেদিন। কেবিন-বয়কে ডেকে দু’কাপ চা আনালাম। আরো দুটো সিগারেট টানলাম। কবে কোনকালে আমাদের তিনটা বিড়াল ছানা হয়েছিলো, রুমাদের বাড়ির একটা কুকুরের প্যারালাইসিস হয়েছিলো, এসব গল্পও চলে আসলো। একে একে ব্যালকনি খালি হয়ে গেলো। প্রায় সব কেবিনের আলোও নিভে গেলো। আমরা দু’জন তখনও গল্প করে যাচ্ছিলাম। রাত একটার দিকে বাতাসটা বেড়ে যাওয়ায় আমার খুব শীত লাগছিলো। এদিকে আমরা কথাও ত্যাগ করতে পারছিলাম না। রুমা সেটা বুঝতে পারলো। বললো, “চলুন, আপনার রুমে গিয়েই গল্প করি।“

মধ্যবিত্ত-মনকে বললাম, পুরুষ নয়, মানুষ হতে শেখ্। মুখে বললাম, “চলুন, যাওয়া যাক।“

রুমা কেবিনের পর্দাটা টেনে দিতে দিতে বললো, “বাইরের কেউ দেখে মাইন্ড করতে পারে। আমি আমার রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে আসি।“

রুমা তার রুমের বালিশটা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো। বললো, “দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে আমার আবার বালিশে হেলান দিয়ে বসতে ভাল লাগে। আপনারও যদি তেমন বদভ্যাস থাকে, তাই বালিশটা নিয়ে এলাম।“

রুমা এবার তার নিজের জীবনের গল্প শুরু করলো। সে যখন নাইনে পড়ে তখন তার ট্রাক চালক বাবা একটা দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার আগে পর্যন্ত জীবনটা বেশ সুন্দরই চলছিলো। বাবা মাঝে মাঝে বাংলা মদ পান করে এসে মায়ের সাথে ঝগড়া করতেন, দু’একদিন দু’একটা চড়-থাপ্পরও দিতেন, কিন্তু এর বেশি আর কোন গোলযোগ ছিলো না তাদের ঘরে। ঝালকাঠিতে একটি টিনের ঘর ভাড়া করে থাকতো ওরা। তিন বোন। তিনজনের বয়সই খুব কাছাকাছি। বাবা তাদের তিনজনকেই খুব ভালবাসতেন। বাবার মৃত্যু তাদের সংসারটা এলোমেলো করে দিয়েছিলো। রুমা সবার বড়। ঝুমা ও ময়না এইট ও সিক্সে পড়তো। ওদের আর পড়াশুনা হয় নি। দু’জনকেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ওদের বিয়েতে সাহায্য করেছে। তবে তার জন্য নিজের শরীরকে ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে বিক্রি করতে হয়েছে রুমাকে।

রুমার কোন উপায় ছিলো না। বাবার মৃত্যুর পরে মা এতোই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, তাদের সবার না-খেয়ে মরার যোগাড় হয়েছিলো। ওয়ার্ড কমিশনার কামরুলের কাছে তাকে যেতে হয়েছিলো মায়ের জন্য সরকারী ভাতার কাগজ প্রস্তুত করার জন্য। মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলো। রুমা নিজের পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে হয়েছিলো। রুমা হারতে চায় নি। সে এখনো জানে না সে হেরেছে কিনা। বড় হবার খুব ইচ্ছে ছিলো তার। নিজের শরীরকে খুব অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার। একদিন সে বড় হলে এ-কথা কেউ মনে রাখবে না। পড়াশুনা শেষ করে নিজ শহর ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে অন্য কোন শহরে চলে যাবে।

রুমা এখন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ওয়ার্ড কমিশনার কামরুলের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। ঢাকাতে টিউশনি করে নিজে পড়ে এবং মায়ের খরচও চালায়। নিজের অতীতকে ভুলতে চায় কিনা জানতে চাইলে জানালো, “ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়! আমার দেশ আমাকে ভুলতে দেয় না। আমাদের সমাজ আমাদের মানসিকতাকে এভাবেই গড়েছে। জোর করে নিজেকে ওপরে টেনে তুলতে চেয়েছি। তুলেছিও হয় তো। কিন্তু কখনো যখন অতীতকে ভাবতে বসি কান্না পায়।“

আমি কী বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দু’জন নীরবে চুপচাপ বসে থাকলাম। আমি দরজা খুলে বাইরে তাকালাম। কেবিন বয়কে খুঁজে পেলে চা বা কফি আনতে বলতাম। পেলাম না। রুমা তখন কাঁদছে। নীরবে। গাল বেয়ে নেমেছে চোখের জল। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম, মধ্যবিত্ত মন ওর কাধে হাত রেখে ওর প্রতি সহানুভূতি জানাতে পারছিলো না; দাঁড়িয়েই রইলো।

রুমা উঠে দাঁড়ালো। ভাবছিলাম বুঝি ওর কেবিনে চলে যাবে। আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নার দমকে ও কাপছিলো। আমি ওর মাথাটা তুলে ওর চোখে চুমু খেলাম। চোখের জলের নোনতা স্বাদ লাগলো জিহ্বায়। আমি তোয়ালে দিয়ে গাল থেকে চোখের জল মুছে দিলাম। কান্না থামিয়ে বললো, “আসুন, ঘুমিয়ে পড়ি।“

আমি যন্ত্রের মতোই ও যা বলে যাচ্ছিলো তাই শুনছিলাম বা করছিলাম। সিঙ্গেল খাটে ভাগাভাগি করে শুয়ে পড়লাম দু’জন। ভালবাসাবাসিতে তলিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই।

বুড়িগঙ্গার জলের পঁচা গন্ধে ঘুম ভাঙলো যখন তখন লঞ্চ সদরঘাটের কাছাকাছি। রুমা তখনো ঘুমাচ্ছে। আমি ওর মুদ্রিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম। আরেকবার চুমু খেলাম চোখে। ওর ঘুম ভেঙে গেলো। আমরা আরো একবার শরীরের ভালবাসায় ডুবলাম।

লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে ও উঠে দাঁড়ালো। দরজা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে বললো, “তোমাকে ধন্যবাদ। এই প্রথম কেউ আমাকে সুখ দিলো।“ পূর্বের মতোই আমার মুখে কোন কথা যোগালো না।

আমরা একত্রেই লঞ্চ থেকে নামলাম। আমি সিএনজি নিয়ে ওকে আমার সাথে উঠতে বলেছিলাম; ওঠে নি। ওর মোবাইল নম্বর চেয়েছিলাম; দেয় নি। আমার ভিজিটিং কার্ডটা চেয়ে নিয়েছিলো। প্রয়োজনে ফোন করবে বলেছিলো। কোনদিন প্রয়োজন হয় নি হয় তো।

আজ আরো বেশি কষ্ট লাগছে রুমাকে ভেবে। উন্নত বিশ্বে জন্মালে বেঁচে থাকার জন্যে, শিক্ষার জন্যে শরীর দিতে হতো না তাকে। শিক্ষার জন্য কোন টিউশন ফি তো লাগতোই না, প্রয়োজন হলে নিজের চলার জন্যে সুদমুক্ত ঋনও পেতো সরকারের নিকট হতে। উন্নত বিশ্বের রুমাদের চোখের জলও কি লবনাক্ত? কে জানে!

আমি জানি না, রুমাকে ভুলে যেতে আবার কতোদিন লাগবে।

(এটা নিছকই একটা গল্প। সন্ন্যাসীর ব্যক্তি জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেললবেন না প্লিজ)

4 Comments

  1. Choity Ahmed

Leave a Comment