শিশুতোষ গল্প

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ গল্পঃ পুতুল বিয়ে

bengali-couple-doll-FP78_l

মিতু বায়না ধরেছে এবারের শীতের ছুটিতে তাকে মামা বাড়ি নিয়ে যেতেই হবে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে মিতু একবারের জন্যও মামা বাড়িতে যায়নি। স্কুল যখন ছুটি হয় তখন তার মার অফিস খোলা থাকে। তাই গত তিন বছরে তার মামা বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠেনি। মিতুর রাসেল মামা যখন ঢাকাতে তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল তখন তাকে বলেছিল যে বেড়াতে গেলে মামা তাকে অনেক জোনাকী ধরে দিবে। মিতু কখনো জোনাকী পোঁকা দেখেনি। দেখলেও সে তা মনে করতে পারছে না। একদিন কম্পিউটারে মামা তাকে জাপান দেশের একটা সিনেমাও দেখিয়েছিল। সে সিনেমাটায় অনেক জোনাকী পোঁকা ছিল। সিনেমাটায় অনেক যুদ্ধ ছিল। মামা বলেছিল যে ওরকমই একটা যুদ্ধ করেছিল নাকি মিতুর দাদু। মিতুর মাও অনেকবার বলেছে। কিন্তু দাদু কখনো ঢাকা বেড়াতে আসেনি। মিতু তার দাদুকে মনেও করতে পারে না। মামা বাড়ি গিয়ে সে দাদুর কাছে যুদ্ধের গল্প শুনবে, মামার সাথে জোনাকী ধরবে। কী মজা হবে! ভাবতেই মিতুর নাচতে ইচ্ছে করছে।

শীতের ছুটি কাছে আসতেই মিতু তার বাবা-মাকে তাড়া দিচ্ছে। একটানা অনেকদিন কাজ করে করে তারাও ক্লান্ত। তারাও চাচ্ছেন একটা লম্বা ছুটি নিয়ে গ্রামে বেড়িয়ে আসতে। তাদেরও ইচ্ছে করে শীতের সকালে মুড়ি ভিজিয়ে খেঁজুরের রস খেতে। এমনকি শীতের সকালে শিশুবেলায় তারা শুকনো ডালপাতা জড়িয়ে যে আগুন পোহাতো মিতুকে দেখে সে ইচ্ছেটাও তাদের জাগে। এতটুকু মিতু প্রতিদিন কতগুলো বই পড়ে, অথচ ওর বয়সে তারা সারাদিন খেলাধুলা করেই কাটাত। সারাদিনে দুই ঘণ্টা স্কুল ছিল, সেখানেও ছিল কত খেলা। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো হবে না, মিতুর মা অফিস থেকে মাত্র সাত দিনের ছুটি পেলো। মিতুর বাবা ব্যবসা করে। সাত দিনের জন্য ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ রাখলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই মিতুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ঠিক হয়েছে ডিসেম্বরের ১২ তারিখ তারা ঢাকা থেকে লঞ্চে বরিশাল যাবে। বরিশাল থেকে বাকি পথটুকু যেতে হবে বাসে এবং তারপরে রিক্সায় এবং কিছু পথ হেঁটেও যেতে হবে। মামা বলেছিল সে পথটুকু একটা বাগানের মধ্য দিয়ে। সে বাগানে অনেক নারকেল-সুপারী গাছ, অনেক সুন্দর সুন্দর ঘাসফুল এবং আরো অনেক ধরনের বুনফুল। মিতু মনে মনে সে ফুল কুঁড়ানোর কথা ভাবে। ফুলের ওপর নানা রঙের প্রজাপতি ওড়ে। মিতু সে প্রজাপতিগুলোর পিছনে দৌঁড়ায়। কত কী ভাবে মিতু!

মিতুরা উত্তরায় থাকে। ঢাকা সদরঘাট থেকে বরিশালের লঞ্চ ছাড়বে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। কিন্তু মিতুর বাবা দুপুরের পরপরই রওয়ানা হতে চায়। উত্তরার রাস্তায় সকাল থেকে দুপুর রাত পর্যন্ত জ্যাম লেগে থাকে। বিকাল তিনটায় সিএনজিতে রওয়ানা হয়ে সদরঘাট পৌঁছাতে তাদের সাড়ে ছয়টা বেজে গেলো। মিতু তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “বাবা, নদীতেও কি জ্যাম থাকে?” শুনে তার বাবা হো হো করে হেসে উঠেছিল। বাবার হাসিতে মিতুর মন খারাপ হলো। বাবা সেটা বুঝতে পারলো। সে তাকে বুঝিয়ে দিলো যে নদীতে জ্যাম থাকে না এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতেও ট্রাফিক জ্যাম থাকে না বললেই চলে।

লঞ্চে উঠতেই বিশ্রী একটা দুর্গন্ধে মিতুর বমি আসছিল। মিতুর বাবা জানালো যে এটা বুড়িগঙ্গার নষ্ট জলের দুর্গন্ধ। সে তাকে বুড়িগঙ্গার কুঁচকুঁচে কালো জল দেখালো। কী বিশ্রী গন্ধ! মিতু ও মিতুর মা নাক চেপে ধরে রাখলো। কিন্তু কতক্ষণ আর নাক চেপে রাখা যায়? লঞ্চ ছাড়তে এখনো প্রায় দুই ঘণ্টা বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যে মিতু ও মিতুর মা বমি করে দিলো। বমি শেষে মিতু ক্লান্ত হয়ে পড়লো। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে গন্ধটাও তাদের নাকে সয়ে গিয়েছিল। মিতু জানতে চাইলো, “বাবা, নদীর জলে এমন দুর্গন্ধ কেনো?” মিতুর বাবা জানালো যে ঢাকা শহরের মানুষগুলো মোটেই পরিবেশ সচেতন নয়, এজন্যই বুড়িগঙ্গা নদীর এমন অবস্থা। ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা ও কলকারখানার ময়লা-আবর্জনা যদি বুড়িগঙ্গায় না ফেলা হতো তাহলে নদীর জল এমন হতো না। মিতু ভেবে পায় না কেন ঢাকা শহরে এতো জ্যাম, কেন মানুষ নদীকে দূষিত করে। মিতু তার বাবার কাছে জানতে চায় না যে সব নদীতেই এমন নষ্ট জল কিনা কারণ ইতোমধ্যে মিতু বুঝে ফেলেছে যে ঢাকা শহরের বিষয় বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন।

লঞ্চ বুড়িগঙ্গা থেকে পদ্মার কাছাকাছি আসতেই আর দুর্গন্ধ নেই। মিতুর বাবা জানালো যে তারা এখন পদ্মা নদীতে। মিতুর বাবা তাকে নিয়ে ব্যালকনিতে একটা চেয়ারের ওপর বসে আছে। হুহু করে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। রাতের অন্ধকারে মিতু পদ্মা নদীকেও দেখতে পারছে না। শুধু কিছু দূরে দূরে অনেক আলো দেখতে পাচ্ছে।  বাবা বললো- “ঐ যেখানে একসাথে অনেক আলো দেখতে পাচ্ছো ওগুলো একেকটা এটার মতো লঞ্চ। কোনটা ঢাকা যাচ্ছে, কোনটা আমাদের লঞ্চটার মতো ঢাকা থেকে ফিরছে। আর ঐ যে ছোট একটা বা দুটো আলো দেখছো সেগুলো ইলিশ মাছ ধরার নৌকা। আরো দূরে ঐ যে অনেক আলো দেখছো বেশ খানিকটা দূরে সেগুলো একেকটা বাজার। নদীতে ধরা ইলিশ মাছগুলো ঐ বাজারে বিক্রি হয়। সমস্ত পদ্মা-মেঘনার পাড় জুড়েই এমন অনেক বাজার আছে।“

একটু পরেই আকাশে চাঁদ উঠলো। মিতু পদ্মা নদী দেখতে পাচ্ছিল। সে কয়েকটা মাছ ধরা নৌকাও দেখতে পেল। বেশ কয়েকটা লঞ্চ দেখতে পেলো। এখন একটা লঞ্চ তাদের লঞ্চের পাশাপাশি চলছে। বেশ উচ্চস্বরে কড়কড় শব্দ হচ্ছে দুটো লঞ্চের শব্দ মিলে। বাবার কোলে বসে নদী-লঞ্চ-নৌকা দেখতে দেখতেই মিতু ঘুমিয়ে পড়লো।

খুব সকালেই ওরা বরিশাল পৌঁছে গেলো। লঞ্চ থেকে নেমে রিক্সায় বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাসে রাজাপুর। রাজাপুর যেতে ওরা ছোট একটি খালের ওপর বিরাট একটা ব্রিজ দেখতে পেলো। বাবা জানালো যে এটা গাবখান ব্রিজ। কতো উঁচু ব্রিজ! ব্রিজটা ঘর-বাড়ি-গাছের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। মিতুর নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছিল। তার ইচ্ছে করছিল বাস থেকে নেমে ব্রিজটার ওপরে হাঁটতে। বাবাকে বলতে বাবা বললো, “একদিন বিকেলে আমরা এখানে বেড়াতে আসবো।“ মিতু বাবার গালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “বাবা, তুমি খুব ভাল বাবা।“

রাজাপুরে পৌঁছাতেই মিতু রাসেল মামাকে দেখতে পেলো। মামা একটা ভ্যান নিয়ে বসে আছে। সবাই মিলে এক ভ্যানে চললো ওরা। মামার কোলে বসেছে মিতু। যেতে যেতে অনেক গাছের নাম জেনে নিচ্ছে মিতু। অনেক গাছই মিতু আগে দেখেনি। একটা খালের পাড়ে ছোট একটা ব্রিজের কাছে গিয়ে থামলো ভ্যানটা। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হবে।

মিতুর কাছে মনে হয় এ যেন স্বপ্নের দেশ। গাছপালার মধ্য দিয়ে ছোট কাঁচা রাস্তা। রাস্তার পাশে লাল-নীল-সাদা খুব ছোট ছোট ঘাসফুল। মিতু ঘাসফুল কুড়াতে লেগে গেল। ছোট ছোট হলুদ প্রজাপতি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে। বাবা-মা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। মামা তার জন্য অপেক্ষা করছে। মামা ডাকলো, “মামনি, এবার এসো। আমাদের ঘরের পাশে বড় মাঠ আছে। সেখানে আরো বেশি ঘাসফুল আছে।“

মামার ডাকে মিতু ফিরে আসে, যদিও তার আসতে ইচ্ছে করছে না। মামা বলে, “বাসায় তোমার জন্য অনেক ফুল আছে। তুমি তুলবে আর মালা গাথবে।“ এবার মিতু দৌঁড়ে ওর বাবা-মাকে ধরে ফেললো এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই মামা বাড়িতে পৌঁছে গেলো।

মামা বাড়িতে পৌঁছাতেই পুকুর পাড়ে হুইল চেয়ারে বসা এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলো মিতু। তিন বছর বয়সে মিতু শেষ মামা বাড়ি এসেছিল। তারপর আরো তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। দাদুকে সে চিনতেই পারেনি। দাদু তাকে ডাকলো, “দাদুমনি, আমার কোলে এসো।“

মিতু বুঝতে পারছে না কী করবে। এই যে তার দাদু সেটাই সে চিনতে পারছে না। তার ওপর আবার হুইল চেয়ারে। সে কোলে নিবে কী করে? মিতুর মা মিতুর হাত ধরে দাদুর কাছে নিয়ে বললো, “যাও মা, দাদুর কাছে যাও।“

দাদু তাকে কোলে নিতে পারছে না। তাকে কাছে টেনে গাল ছুঁয়ে আদর করলো। “তুমি আমাকে চিনতে পারছো না দাদু?”

“না..হ্যাঁ, পারছি তো। কিন্তু তুমিও তো বেড়াতে যেতে পারতে এতোদিনে।“
“দাদু, আমি যে হাঁটতে পারি না। কোথাও গেলে মানুষের বোঝা হয়ে যাই, তাইতো কোথাও যাই না।“

মিতুর দিদিমা এসে মিতুকে কোলে নিল। মিতুর মা দাদুর হুইল চেয়ার ঠেলে ঘরে নিয়ে আসলো।

বাড়িতে কত বড় উঠান। উঠানে অনেক প্রকার ফুল গাছ। ঘরের পাশে একটি কাগজ ফুল গাছে মাচা দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে গাছটা। গাছের তলায় অনেক ফুল পড়ে আছে। উঠান পেরিয়েই বড় পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ দিকে বেশ বড় মাঠ। আজ ছুটির দিন। সেখানে অনেক ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। মিতু প্রথমে কিছু কাগজ ফুল কুঁড়ালো, তারপর ঘাসফুল কুড়াতে লেগে গেলো। মিতুর দেখাদেখি তাকে সাহায্য করতে আসলো আরেকটি মেয়ে। মিতু খুব অবাক হলো।

“তোমার নাম কী?”
“সাবিনা।“
“কোন ক্লাসে পড়ো?”
“ওয়ান। তুমি?”
“আমিও প্রথম শ্রেণীতে পড়ি।“
মিতু আরো জানলো যে সাবিনাদের বাড়ি এখান থেকে পশ্চিম দিকে আরে দুটো বাড়ি পরে।
“তুমি বাড়ি ছেড়ে এতোদূর এসেছো তোমার ভয় করেনি?”
“কেন ভয় করবে? আমি এখান থেকে একশ্বাসে বাড়ি দৌঁড়ে যেতে পারি।“
একশ্বাসে দৌঁড়ে যাওয়া কী মিতু তা বুঝতে পারে না।
“তোমার মা বকবে না?”
“কেন বকবে? আমি তো খেলতে এসেছি।“
বাড়ি থেকে এতো দূরে খেলতে আসলে মা কেন বকবে না, তাও মিতু বুঝতে পারে না। সাবিনার মা খুব ভাল- এমন একটা ভাবনা তার মাথায় ঘুরছে।
সাবিনা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমাদের বাড়ি যাবে? আমাদের বাড়ির বাগানে টুকটুকে লাল রংয়ের ফুল আছে।”
“মাকে বলে দেখবো। মা যেতে দিলে যাবো।“

মিতুর দিদিমা তাকে ঘরে ডাকছে। মিতুর যেতে ইচ্ছে করছে না। মাঠের এক জায়গায় তারা অনেক নীল রঙের ফুল পেয়েছে। খুব ছোট ছোট ঘাসফুল। দিদিমা এসে তাকে নিয়ে গেলো। সাবিনা বলছে, “আমি বাড়ি যাই।“
“তুমি কি একশ্বাসে দৌঁড়ে যাবে?”
“না, এখন তো আমার তাড়া নেই।“

দিদিমা সাবিনাকেও সাথে নিয়ে আসলো। তারপর ওদেরকে সফেদা খেতে দিলো। কী মিষ্টি! দুটো ফল খেতেই মিতুর মুখ ফিরে আসলো। সাবিনাও একটা খেলো। তারপর দুজনে আবার ঘাসফুল কুঁড়াতে চলে গেলো।

সারাদিনই ওরা ফুল কুড়ালো এবং খেললো। সাবিনা দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে কয়েকটা পুতুল নিয়ে এসেছিল। দুপুরে সাবিনাও ওদের সাথে খেল। মিতুর অবাক লাগছে যে সাবিনার মা একবারের জন্যও তাকে খুঁজতে আসেনি। আবার ভালও লাগছিল যে খুঁজতে আসলে সাবিনাকে চলে যেতে হবে। আরো অবাক হচ্ছিল ডিসেম্বরের এই শীতে সাবিনা কেবল একটি পাতলা জামা গায়ে ও খালি পায়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলো। সন্ধ্যা হতেই মিতু দেখলো যে তার জামা-কাপড়ও সব ধুলো-কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। তার মা তাকে ইতোমধ্যে কয়েকবার সতর্ক করেছিল কিন্তু বাবা ও রাসেল মামা প্রতিবারই বলেছে, “একটু ধুলো-কাদা লাগুকই না। গ্রামে তো আর সারাজীবন থাকবে না।“

আজ সন্ধ্যায় কোন বই পড়া নেই। কোন শিক্ষকও পড়াতে আসবে না। কী যে আনন্দ লাগছে মিতুর!

এদিকে সন্ধ্যা নামতেই সারি সারি জোনাকী নেমে গিয়েছে। কিছু কিছু গাছে তা খুব বেশি। শহরে কোন বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে যেমন সাজানো হয় তেমন সাজে সেজেছে গাছগুলো। এতো এতো জোনাকী পোঁকা! মিতু যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

মামা তাকে খালের পাড়ে নিয়ে গেল। সেখানে একটা গাছে যেন আগুন লেগেছে। মামা বললো, “ঐ যে গাছটা দেখছো না ওটার নাম ছৈলা গাছ। ও গাছটায় প্রতিমাসে দুই-তিনদিন এমন জোনাকীর মেলা বসে। আমরা ছোটবেলায় বলতাম জোনাকীর বিয়ে। আজ বোধ হয় তেমন বিয়ে হচ্ছে জোনাকীর।“

বিস্ময়ভরা চোখে মিতু হেসে দিল। মামাও হাসলো। চারদিকে একটানা রি-রি-রি আওয়াজ। মামা জানালো যে এগুলো ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক।

মামা যা বলেছে তা যে সত্যি তা মিতু পরীক্ষা করে দেখেছিল। বাকি যে কদিন তারা মামা বাড়িতে ছিলো আর একদিনও ঐ ছৈলা গাছটিতে এমন জোনাকীর মেলা দেখেনি। তবে অন্য গাছে দেখেছে। মামা তাকে কয়েকটা জোনাকী ধরে পলিথিনে ভরে দিয়েছিল। মিতুর সেই সিনেমাটির কথা মনে পড়ে গেলো। সেখানে অনেকগুলো জোনাকী ধরে দুই ভাই-বোন মশারীর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ঘরে আলোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সকালে উঠে দেখে সব জোনাকীগুলো মরে গিয়েছে। মিতু ওদেরকে মারতে চায় না। এতো সুন্দর পোঁকা কি মারা যায়! মিতু সব জোনাকীগুলো ছেড়ে দিল, তবে একটা বুদ্ধি করে। পলিথিনটার এক কোনায় একটা ছিদ্র করে দিল। যে জোনাকীরা ওখান থেকে বের হয়ে যেতে পারবে তারা উড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত দুটো জোনাকী কিছুতেই পথ খুঁজে পায়নি। মিতু নিজে থেকেই ওদেরকে ছেড়ে দিলো।

রাতের খাওয়া শেষে মিতু দাদুকে ধরলো তার যুদ্ধের গল্প শোনার জন্য। যে যুদ্ধে দাদু তার দুটো পাই হারিয়েছে সে যুদ্ধের গল্প। রাসেল মামা দাদুকে খাটে শুতে সাহায্য করলো। মিতুও শুলো দাদুর পাশে। দাদু একটা কম্বল টেনে দিলো দুজনার গায়ে।

“দাদু, তোমার যুদ্ধের গল্প বলো।“
“দাদুমনি সে তো অনেক বড় গল্প। তুমি শুনতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।“
“তবুও বলো। তার আগে বলো তুমি কেন যুদ্ধ করতে গেলে? যুদ্ধে তো মানুষ মারতে হয়। মানুষ মারা কি ভাল কাজ?”
“দাদুমনি, মানুষ মারা মোটেই ভাল কাজ নয়। কিন্তু কেউ যদি তোমার বাবা-মা-মামা এদেরকে মারতে আসে, তবে তুমি কী করবে?”
“আমিও তাকে একটা বন্দুক দিয়ে মেরে ফেলবো।“
“আমি তো সেজন্যই যুদ্ধে গিয়েছিলাম দাদুমনি। ওরা আমাদের দেশের কত মানুষকে কোন কারণ ছাড়াই মেরে ফেললো তা দেখে আমি কি যুদ্ধে না গিয়ে পারি বলো?”
“ওরা মারলো কেনো?”
“কেন মারলো সে তুমি এখনই বুঝবে না। কিন্তু ওরা এক রাতে হঠাৎ করেই আমাদের মারতে শুরু করলো। আমি তখন ঢাকাতে পড়াশুনা করি।“
“ওরা কারা?”
“পাকিস্তানীরা।“
“তখন তুমি স্কুলে পড়তে?”
“হ্যাঁ, দাদু। তবে একটু বড় স্কুলে, যাকে সবাই বিশ্ববিদ্যালয় বলে। ওরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করে এক রাতেই আমাদের অনেক বন্ধু ও স্যারদের মেরে ফেললো। আমি কোনমতে পালিয়ে বাঁচলাম।“
“তারপর?”
“তারপর আমি পালিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী সাতরে ওপারে গেলাম।“
“ঐ পঁচা বুড়িগঙ্গা নদীটা তুমি সাতরে পার হলে?”
“তখন ওটা পঁচা ছিল না দাদু। ওটার জল মানুষ খেতোও।“
“তারপর কী হলো?”
“তারপর সেখান থেকে হেঁটে, নৌকায় অনেক কষ্ট করে এই বাড়িতে পৌঁছালাম। কিন্তু খবর পেলাম যে ওরা সারা বাংলাদেশেই তখন মানুষ হত্যা করছে। আমি তখন আবার ঢাকা গেলাম। তারপর অন্য অনেক বন্ধুদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলাম।“
“তারপর? তুমি ওদের মারলে?”
“হ্যাঁ, মারলাম। আমাদেরও অনেকে প্রাণ হারালো।“
“তুমি পা হারালে কীভাবে?”
“আমরা প্রথমে ঢাকায় যুদ্ধ করলাম। তারপর আমাকে খুলনায় পাঠানো হলো। খুলনাতে আমরা ওদের কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।“
“মাইন কী”?
“মাইন এক প্রকার বোমা।“
“তারপর?”
“এক রাতে একটা স্কুলে বসে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিছু রাজাকার আমাদের খবর পৌঁছে দিলো পাকিস্তানী সেনাদের কাছে।“
“রাজাকার কী দাদু?”
“রাজাকার হলো তারা যারা বাংলাদেশী মানুষ হলেও পাকিস্তানীদের সাথে মিশে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করতো।“
মিতু বিস্মিত হয়। “তাই!”
“হ্যা দাদুমনি। তারপর পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের কয়েকজন যোদ্ধা গুলি খেয়ে মারা গেলো। আমিসহ আরো কয়েকজন দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে গুলি খেলাম। আমার দুই পায়েই মেশিনগানের গুলি লাগলো। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। তারপর কোনক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে একটা কচুরিপানা ভর্তি খালে নেমে কচুরীপানার মধ্যে লুকালাম।“

মিতু প্রায় শ্বাস বন্ধ করে গল্প শুনছিল। দাদু থেমে গেলেও সে একটা কথাও বলছিল না। দাদু তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। দাদু আবার বলতে শুরু করলো।
“আমি ঘণ্টাখানেক কচুরিপানার মধ্যে নাক উঁচিয়ে টিকে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি আমি মারা যাবো। জলের মধ্যে অনেক জোঁক। রক্ত শুষে নিচ্ছিল কিন্তু আমি সেগুলোকে দূরে ছুড়ে মারতে পারছিলাম না। ওদিকে পাদুটো পুরো অবশ হয়ে গিয়েছিল। ঘোর বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে পাকিস্তানী সৈন্যরা খুব বেশি সময় ওখানে থাকলো না। ঘণ্টাখানেক পরে ওরা চলে গেলে আমি কিভাবে যে খাল থেকে ওপরে উঠেছিলাম তা মনে নেই।“
“দাদু, আমি আর শুনবো না।“
“কেন দাদুমনি?”
মিতু আর কোন কথা বললো না। আরো জড়সড় হয়ে দাদুর বুকের মধ্যে গুটিয়ে গেল। দাদুও ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। তারপর ঘুমিয়ে গেলো।

এরপরে মিতু যে কদিন মামা বাড়িতে ছিল দাদুর যে কোন সাহায্য লাগলেই দৌঁড়ে আসতো। একদিন সে দাদুকে প্রশ্ন করলো- “দাদু, তোমাদের যুদ্ধ শেষ হলো কবো?”
“দাদুমনি, তোমাদের স্কুলে তোমরা যেদিন বিজয় দিবস পালন করো সেদিন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে।“
দাদু যেদিন এ কথা বলে তার পরের দিনই ছিল ১৬ ডিসেম্বর। মামা তাকে ওখানকার স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। সাবিনাও সঙ্গে ছিল। সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের ফুল দিয়েছিল মিতু, সাবিনা ও মামা।

এভাবে কেটে গেলো পাঁচটি দিন। দিনে সাবিনার সাথে খেলা, সন্ধ্যায় মামার সাথে জোনাকী দেখা ও রাতে দাদুর কাছে গল্প শোনা। এরই মধ্যে মিতু সাবিনাদের বাড়িতে বেড়িয়েছেও। সাবিনার বাবা নেই। মা বেশিরভাগ সময়ই বাড়ি থাকে না। দুপুরে সাবিনা প্রায়ই একা একা ভাত বেড়ে খায়। তবে সাবিনার মা সাবিনাকে খুব ভালবাসে। মিতু ওদের বাড়িতে মুড়ির মোয়া খেয়েছে। সাবিনার মা তাকে দুটো পুতুলও বানিয়ে দিয়েছে। সাবিনাও তার পুতুল থেকে দিয়েছে আরো দুটো। কিন্তু মিতু কিছুই দিতে পারেনি। সাবিনার নিজের পুতুল আছে, কিন্তু মিতুর নিজের কিছুই নেই।

এদিকে মামা তাকে একদিন চমকে দিয়েছে। একদিন দাদুর কাছে শুয়ে গল্প শুনছিল। এমন সময় মামা তার মোবাইলে রেকর্ড করা ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক ছেড়ে দিয়ে মিতুর মাথার কাছে রেখে দিয়েছিল। মিতু লাফ দিয়ে উঠে বসেই বললো, “মামা মামা, বিছানার মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোঁকা!”
মামা তো হেসেই খুন।

সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে বলে ফেরার দিন মিতুর খুব মন খারাপ হলো। আশেপাশে কোথাও সাবিনাকে দেখতে না পেয়ে তার আরও মন খারাপ হলো। সবাইকে একটু অপেক্ষা করতে বলে মিতু একশ্বাসে দৌঁড় দিয়ে সাবিনাদের বাড়িতে চলে গেলো। এরই মধ্যে সে একশ্বাসে দৌঁড় শিখে গিয়েছে।

সাবিনা তখন আরো দুটো পুতুল বানাচ্ছিল। পুরুষ পুতুলটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে পুতুলটার চুল লাগানো বাকি তখনো।
মিতু অভিযোগের সুরে বললো, “আমরা চলে যাব, তুমি আসলে না কেন?”
“আমি তোমার জন্য আরো দুটো পুতুল বানাচ্ছিলাম। কিন্তু মেয়ে পুতুলটা বানাতে এতো দেরী হয়ে গেলো! চুলগুলো মোটেই লাগাতে পারছি না। এদিকে মা-ও নেই যে বানিয়ে দিবে।“

মিতু পুরুষ পুতুলটা হাতে নিয়ে বললো, “আমি এটাই নিয়ে যাই। আবার যখন আসবো তখন আমার এই পুরুষ পুতুলটা নিয়ে আসবো। তখন তোমার মেয়ে পুতুলটার সাথে এটার বিয়ে দিবো।“

3 Comments

  1. Ranjit Paul

Leave a Comment