বাংলা ব্লগের শুরু ২০০৬ সালে বা তারও আগে ফোরামকেন্দ্রিক লেখালেখি চালু থাকলেও ব্লগিংয়ে আমার হাতেখড়ি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। ব্লগিংয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সামহোয়্যারইন ব্লগের মুক্তমনা/নাস্তিক ব্লগারদের সাথে আমার জোট বেঁধে যায়। এর শুরুটা হয়েছিলো ব্লগার শয়তান থেকে। ক্রমে বাংলাদেশে থেকে ব্লগিং করা সামহোয়্যারইনের বেশিরভাগ নাস্তিক ব্লগারদের সাথেই ভার্চুয়ালের বাইরেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একইসাথে অন্য ব্লগগুলো, বিশেষ করে মুক্তমনা ব্লগের ব্লগারদের সাথেও ভার্চুয়াল জগত ও বাইরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১০ সালে ব্লগে আসার পর থেকে ইসলামী জঙ্গিবাদের শিকার হয়ে অকালে হারানো সহযোদ্ধা রাজীব, অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নীলয়কে নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণ।
রাজিবের কথা মনে পড়লেই তাঁর সেই হাসিমুখের মিষ্টি বাংলা উচ্চারণগুলো মনে পড়ে। জোরে কথা বলতেন না মোটেই; কোন কথায় তীব্রতা বুঝাতে চাইলে চোখ আর কপালে ভাঁজ পড়ে যেতো। তবে কখনোা কখনো হেসে উঠতেন জোরে জোরে। মোবাইলে বেশ তর্কও হয়েছিলো কয়েকদিন, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর পক্ষপাতকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডানোর চেষ্টা করেছি। তাঁর কথা ছিলো, বাঙালি হিন্দুদের ধর্ম পালনের বিষয়টিকে তিনি পুরোই লোকাচার মনে করতেন এবং বলতেন, এ গুলোর সাথে বাংলার ঋতুচক্রের সম্পর্ক রয়েছে। বরিশালে আসার আগে কাঁকড়া খেতে চেয়েছিলেন। খেয়েছিলেন, তবে চিবিয়ে চিবিয়ে যা খেলেন, তাতে মনে হলো না যে, খাদ্যটা তিনি উপভোগ করেছেন। তবে গল্পে গল্পে সময়টা বেশ কেটেছিলো। তাঁর ল্যাপটপ থেকে এক গাদা ঐতিহাসিক ডকুমেন্টারি দিয়ে এসেছিলেন আমাকে। দেখতে গেলেই কষ্ট লাগতো, তাই সেগুলো আর দেখা হয় নি। ঢাকাতে ছবির হাটে একবার একটা বই বাছাই করে দিতে বলেছিলাম। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ বইটা কিনতে বলেছিলেন, যেটা পড়ে ভারতীয় মিথিক্যাল সাহিত্যের ওপর আমার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গিয়েছে।
হয় তো আমি বুড়ো হয়ে যাব, হাসিমাখা মুখটি নিয়ে তুমি চিরযুবাই রয়ে যাবে। প্রকৃতির এমন কোন সাধ্য নেই তোমাকে বুড়ো করে।
অভিজিৎ রায়ের সাথে একবারই দেখা হয়েছিলো। ২০১২ সালের বইমেলায়। আগে দাদার কোন ছবি দেখি নি বলে আরো স্মার্ট চেহারায় দেখবো ভেবেছিলাম। তাঁকে দেখে বুঝলাম, স্মার্টনেজ চেহারায় নয়, স্মার্টনেস হলো জ্ঞানে। আমি মুক্তমনার ব্লগার ছিলাম না; তবুও দাদা আমাকে দেখেই কাছে টেনে নিলেন। চটপটি খেতে খেতে আমাদের দুজনের পেটের ভুরি নিয়ে কতো হাসাহাসি! একটা বই কিনলাম, দাদা অটোগ্রাফ দিলেন। তাঁর সাথে প্রথম দেখার নিদর্শন হিসেবে আমাকে ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি উপহার দিলেন। মুক্তমনায় মাঝে মাঝে মন্তব্য করতাম দু’একটা। একদিন দেখি একটা ফেসবুক মেসেজ এসেছে। দাদা আমার জন্য আইডি খুলে, আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও ওখানে আমার তেমন লেখা হয় নি কখনোই।
দাদা, আপনার দেয়া আলো হাতে চলছি; আমৃত্যু চলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আপনার সাথে তোলা আমার যে ছবি সে ছবিটার এই আমির পরিবর্তন আসবে, আপনি থেকে যাবেন সেরকমই। ছবিটা দেখলেই আপনার সেই রসিকতাগুলো মনে পড়বে আমার। বাঙলা ভাষা যতোদিন থাকবে, আপনার সৃষ্টির মতোই আপনি চিরযুবাই থেকে যাবেন।
ওয়াশিকুর বাবুর সাথে আমার কখনোই দেখা হয় নি। বাবু বলেছিলো, দাদা, এরপর যখন ঢাকায় আসবেন, আমাকে জানাবেন; আমি আপনার সাথে দেখা করবো। টানা হরতাল অবরোধের জন্য ২০১৫ সালের বইমেলায় আর যাওয়া হলো না; বাবুর সাথে আর দেখাও হলো না। হয় তো অভিজিৎদা, বাবুর মতোই আমারও আর কোন দিন বইমেলায় যাওয়া হবে না। বাবু বিচ্ছিন্নভাবে ‘নাস্তিকদের কটুক্তির বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব’ স্যাটায়ার সিরিজটি লিখতেন। আমি একদিন ইনবক্সে তাকে অনুরোধ করলাম এগুলো যেন নোট আকারে প্রকাশ করে। আমার ভাবনা ছিলো, যেহেতু সিরিজের সবগুলো আমার পড়া হয় নি, তাই নোট আকারে দিলে নিজেও পড়বো এবং অন্যদেরও পেতে সহজ হবে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখাগুলো নোট আকারে পোস্ট করে আমাকে ইনবক্সে বলেছিলো, “দাদা, আপনার কথা মতো ‘নাস্তিকদের কটুক্তির বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব’ সিরিজটি নোট আকারে দিয়েছি।” আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো যে, মৃত্যুর পূর্বে ওর কাজগুলোকে ওকে দিয়েই আমি ভবিষ্যতের জন্য গুছিয়ে রাখালাম।
সদ্য যুবক বাবু যুবকই থেকে যাবে। আমাদের মতো রোগ-শোক তাকে জীর্ণ-শীর্ণ করতে পারবে না। আমাদেরকে বহমান রেখে বাবু নিজের সময়কে থামিয়ে দিয়েছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাবুর কৈশোরোত্তীর্ণ সরল মুখচ্ছবি আর তার সৃষ্টি দাঁত ভাঙা জবাবগুলো ধর্মান্ধদের চপেটাঘাত করে চলবে।
অনন্ত বিজয় দাসের সাথেও দেখা হয়েছিলো বই মেলায়। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৈকত চৌধুরী ও তাঁর লেখা ‘পার্থিব’ এবং তাঁর সম্পাদিত বই ‘ডারউইনঃ একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ বই দুটো কিনলাম সেবার। একটা ভিন্নরকম স্মৃতিও জড়িয়ে আছে তার সাথে। মেলা থেকে বের হয়ে আসার আগে অবসর প্রকাশনীতে গেলাম ডারউইন বইটা কিনতে গিয়ে আমার ক্যামেরাটা পকেটমার হয়ে গেলো। ঐ বারে অনেক ছবি তুলেছিলাম আমি। সিলেটে রাজি, সৈকত, পিয়েলদের সাথে কাটানো সময়, সিলেটে আমার ট্যুর এবং সবশেষে বইমেলায় মুক্তমনাদের সাথে তোলা সকল ছবি হারিয়ে গেলো। পরে গীতাদির পোস্ট থেকে কয়েকটা ছবি পেয়েছিলাম। অনন্ত আর আমি একই ব্যাংকে চাকুরী করতাম, যদিও তা আমি জানতাম না। অনন্ত আমাকে আরো ঋণী করে গেলো কতভাবে ! তাঁর মৃত্যুই আমাকে দ্রুত চাকুরী ছেড়ে বিদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিলো। যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমি বাইরে এসেছি, একের পর এক ব্লগার হত্যার জন্যই তারা আমাাকে বাছাই তথা দেশত্যাগ সবকিছুতে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। অনন্তরও এই একই স্কলারশিপ হয়েছিলো এবং বাইরে আসার অপেক্ষায় ছিলো। আমার অপেক্ষা ফুরালো, তাঁর অপেক্ষা আর শেষ হবে না কোন দিন, অনন্তকে আর যেতে হবে না কোথাও। আমাদের অন্তরে তার সরল যুবকের মুখটা ভাস্বর থাকবে চিরকাল।
ভার্চুয়াল জগতের বাইরে নিলয় নীলের সাথে খুব একটা স্মৃতি নেই আমার। একবারই শুধু দেখা হয়েছিলো ঢাকাতে। বরিশালে আমাদের বাসায় একবার বেড়ালেও তখন আমি কর্মস্থলে থাকায় তখন দেখা হয় নি। ঢাকাতে যেবার দেখা হলো, নীলয় একটা সাইকেল নিয়ে আজিমপুরে দেখা করতে এসেছিলো। তখন সম্ভবত ২০১১ বা ২০১২ সাল; নীলয় বেশ শুকনো ছিলো। আজিমপুর থেকে টিএসসি, ছবির হাটে গিয়েছিলাম। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ও আমাকে লিখেছিলো, “দাদা, সতর্ক থাকা উচিৎ। আপনি তো আমাদের মতো একেবারে ভবঘুরে না, একটা সংসার আছে। কোন সমস্যা হলে ওরাও সমস্যায় পড়বে।” আমি তোমার কথা রেখেছি নীলয়, সংসার নিয়ে আজ নরওয়েতে চলে এসেছি। তুমি যদি নিজের কথা আরেকটু ভাবতে! আর ভেবেই বা কী হতো! এ মৃত্যুপুরীতে ঘরের মধ্যেও জীবনের নিশ্চয়তা নেই।
রাজীব, অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নীলয়। প্রতিটি নাম চোখে পড়লে বা মনে আসলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার স্মৃতিগুলো আমাকে পোড়ায়। আমি আর পুড়তে চাই না।
নিলয় আমাকে শেষ ম্যাসেজটা দিয়েছিলো, “কাউকে বিশ্বাস করো না।”
চোখে জল এসে গেল.. !!!!