বাংলাদেশে কি জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়?

পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি নির্মূল করা সম্ভব নয়। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান এবং জঙ্গিবাদ যেহেতু বর্তমান সময়ের ইসলামী ট্রেন্ড, তাই এখানে জঙ্গি নির্মূল করা খুবই দুরুহ কাজ বটে কিন্তু অসম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ নির্মূলের জন্য কিছু দীর্ঘমেয়াদী প্যাকেজ-পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, যার কিছু বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও করাটা খুবই আবিশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুটোই অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিকারের ধাপগুলো সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলেই বাস্তবায়ন সম্ভব এবং প্রতিরোধের ধাপগুলো বাস্তবায়নও অসম্ভব নয়, তবে এর জন্য সরকারকে অনেক কঠোর হতে হবে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম- এটা আমরা সবাই-ই জানি, তাই প্রতিকারের সাথে সাথে প্রতিরোধের ব্যবস্থাও অবশ্যই করতে হবে বলে মনে করি। এই লেখাটিতে প্রতিকারের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। প্রতিরোধের বিষয়টি পরবর্তী পোস্টে তুলে ধরা হবে।

জঙ্গিবাদ প্রতিকারের জন্য কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ১. যেসকল প্রতিষ্ঠান জঙ্গিবাদের উৎস বলে বিবেচিত সেগুলোর তদারকি বৃদ্ধি করা, ২. জঙ্গিবাদে ব্যবহৃত অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যক্তি ট্রেস করার জন্যে প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন, ৩. আইন সংস্কার ও দ্রুত বিচার ত্বরান্বিত করা।

১. জঙ্গিবাদের উৎস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের মূল উৎস মাদ্রাসা, মসজিদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মাদ্রাসা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। আলিয়া মাদ্রাসা, যা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয়; এর সংখ্যা রয়েছে ২৯০০০ এর কিছু বেশি। কওমি মাদ্রাসা, যা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়; এর সংখ্যা ১৭০০০ মতো। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে সরকার প্রণীত সিলেবাস দ্বারা প্রচলিত হলেও কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। তারা তাদের ইচ্ছেমতো সিলেবাস প্রণয়ন করে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য সরকার মাঝে চেষ্টা করলেও তাদের আন্দোলনের মুখে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের জন্য একটিমাত্র শিক্ষাব্যবস্থাই প্রচলিত। আলাদা শিক্ষা দিয়ে মানুষকে শৈশবেই বিভাজন তৈরি করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা যেহেতু শিশুর মৌলিক অধিকার, তাই প্রাথমিক শিক্ষা পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত একক শিক্ষাব্যবস্থাই হওয়া উচিত। কিন্তু আলিয়া মাদ্রাসা সরকারী সিলেবাস পড়ালেও মাদ্রাসাগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো আরো কিছু বিষয় পড়ায়, যার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রন নেই। সরকার নিয়ন্ত্রন করবে কী, উল্টো সরকারকেই এরা নিয়ন্ত্রন করে। মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে মাদ্রাসার বইগুলো থেকে অনেক হিন্দু লেখকদের লেখা সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বেশ কিছু শব্দ কবি/লেখকদের লেখার মূল শব্দ পরিবর্তন করে ইসলামিক শব্দ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, বইয়ের মধ্যে থাকা ছবিগুলোতে মেয়েদের হিজাব পরানো হয়েছে।  কী হাস্যকর! এদিকে কওমী মাদ্রাসাগুলোতে তো আদৌ নিয়ন্ত্রনই নেই সরকারের। তারা ইচ্ছেমতো সিলেবাস নির্ধারণ করে, যার পরতে পরতে রয়েছে জিহাদ এবং অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো।

দুই ধরণের মাদ্রাসায়ই শিক্ষকরা ছাত্রদের মাঝে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে থাকে। প্রতিটি মাদ্রাসায়ই কোমলমতি ছাত্রদের জিহাদ তথা জঙ্গিবাদ দিয়ে মগজধোলাই চলে। ২০১৩ সালের ৫ই মের হেফাজত সমাবেশ থেকেই বোঝা যায় যে মাদ্রাসার ছাত্রদের কতটা মগজ ধোলাই দেয়া হয়। কোমলমতি মাদ্রাসার ছাত্ররা জানেই না ব্লগাররা কোথায় কী লিখেছে, অথচ হুজুরদের কথায় তারা ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে সমাবেশে চলে এসেছে। মাদ্রাসায় কেবল জঙ্গিবাদ ছড়ানোই নয়, জঙ্গিবাদ প্রশিক্ষণেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মাদ্রাসা। এখানে আমি কিছু নিউজ লিংক দিলাম। সংবাদ লিংক-১সংবাদ লিংক-২সংবাদ লিংক-৩

মাদ্রাসার মতোই মসজিদগুলো, বিশেষ করে কিছুটা রিমোট এলাকার মসজিদগুলো জঙ্গি প্রশিক্ষণের অন্যতম স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতি শুক্রবারে মসজিদে যে বয়ান দেয়া হয়, তাতে অন্য ধর্মের প্রতি, নারীর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, কিন্তু এগুলোকে নিয়ন্ত্রন করার কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীম রাহমানির জিহাদী বয়ান শুনতে শুক্রবারে বহু দূরের মানুষও তার মসজিদে নামাজ পড়তে আসতো। খোদ সৌদিতে খুতবায় ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা না বলার জন্য অনেক আলেম চাকুরী হারিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বলা তো দূরের কথা, উল্টো অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশে সারাবছর ধরেই প্রচুর ওয়াজ মাহফিল হয়, যেখানে প্রচুর পরিমানে ঘৃণা ছড়ানো হয়, যা জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়। পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই ওয়াজ মাহফিলকে সরকার নিয়ন্ত্রন করে থাকে। ওয়াজ করতে গিয়ে চরমোনাই পীরের ভাই সৌদিতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, যিনি ৪০ দিন পরে মুক্তি পেয়েছেন। এসব মাদ্রাসা-মসজিদ কি সরকারের আইন নিয়ন্ত্রন সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রনে আনতে পারে না? প্রথমত, যত প্রতিরোধই হোক তাকে মোকাবেলা করে সকল কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে। জঙ্গি দমন করতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার সিলেবাসে পরিবর্তন আনতেই হবে। অতঃপর মাদ্রাসাগুলোকে ঝুঁকির ভিত্তিতে ভাগ করে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মাদ্রাসাগুলোতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে, যাতে সরকারী সিলেবাসের বাইরে পাঠদান, জিহাদে উদ্বুদ্ধকরণ, জঙ্গি প্রশিক্ষণসহ যে কোন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়।

একইসাথে মসজিদগুলোতে খুতবা প্রদানে এবং ওয়াজ মাহফিলে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোকে আইন করে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে সৌদির উদাহরণ তুলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতে পারে। দু’চারজন আলেমকে জেলে ভরলে বাকিরা জেলের ভয়েই এসব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবে। শুক্রবারে পুলিশের এসবি ও ডিবির ফিল্ড লেভেলে দায়িত্বপালনকারীদের এ ব্যাপারে কাজে লাগাতে হবে। তবে এভাবে শহরের মধ্যের মাদ্রাসা-মসজিদগুলোকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলেও দূর গ্রামাঞ্চলের মাদ্রাসা-মসজিদগুলোকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পুলিশ সোর্স ব্যবহার করতে হবে। তারা নিয়মিত ইন্টারভেলে শুক্রবারে বিভিন্ন মসজিদে খেয়াল রাখবে এবং তার আওতার এলাকাগুলোতে মাহফিলগুলো নজরে রাখবে। পুলিশ বা পুলিশ সোর্সদের রেকর্ড ডিভাইস দিয়ে দিতে হবে, যাতে অপরাধ প্রমাণের জন্য রেকর্ড করতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সাথে মসজিদ মাদ্রাসাগুলোই কেবল সংশ্লিষ্ঠ নয়। দেশের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই জঙ্গিবাদ খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশে শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি পাওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা তৈরি করে, জঙ্গি সংগঠনগুলো এই শঙ্কাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রদের মগজ ধোলাই দিয়ে থাকে, এ ধরণের কথা বলে থাকেন অনেকেই। কিন্তু বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের বিচরণ এবং যাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে, সেখানেই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়াকে এর সাথে কিছুতেই মেলানো যায় না। মূলত সবকিছুর ইসলামাইজেশন করা হয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সবকিছুকে ইসলামের নিক্তিতে মাপার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, ফেসবুক পেইজগুলোতে বিচরণ করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাসির তাঁর ফেসবুক পেইজে বোনের ছবি প্রকাশ করলে সেখানে ফেসবুকাররা প্রশ্ন তোলে কেন তার মাথায় হিজাব নেই, কেন সে ইসলামের নিয়ম মেনে চলে না। যে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক সংবাদ, তা যদি ধর্মের সাথে সামান্য সাংঘর্ষিক হয় তবে সেখানে উল্টা-পাল্টা মন্তব্য, গালাগালি করে ভরিয়ে দেয়া হয়। এগুলো ইসলামাইজেশনের প্রভাব। কারণ যাই হোক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ছাত্রদের কাজে লাগিয়েই কিভাবে গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা যায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জঙ্গিবাদের সম্ভাবনাভিত্তিক ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে হবে এবং সে-অনুযায়ী গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।

২. প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার মাধ্যমে জঙ্গি নিয়ন্ত্রনঃ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় দূর্নীতি-সন্ত্রাস কমে যাওয়ার প্রধান কারণ যে কেবল মানুষের উন্নত নৈতিকতা তা নয়, উন্নত প্রযুক্তি তাদেরকে দুর্নীতি-সন্ত্রাসে জড়াতে প্রতিবন্ধকতা হয়ে কাজ করছে। দূর্নীতি-সন্ত্রাসের সাথে জড়িত যে কোন ব্যক্তিকে যদি সহজেই চিহ্নিত করা যায় তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সহজ হয়ে যায়। এ জন্যে  প্রথমেই যে আবশ্যিকতাটা আসে তা হলো একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেইজ, যাতে প্রতেকটি মানুষের একটি পার্সোনাল নম্বর থাকবে এবং যেটি সবকিছুতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশে কেবল পূর্নবয়স্কদের জন্য একটি জাতীয় পরিচয়পত্র করা হলেও তা একটি কাগজ মাত্র, এটিকে একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেইজে রূপান্তরিত করা এবং একইসাথে পরিচয়পত্রটি ডিজিটাল পরিচয়পত্র করতে পারলে এই কাজটি অনেকটা এগিয়ে যেতো। এর সাথে শিশুদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রদত্ত জন্মনিবন্ধনই ডাটাবেইজ হিসেবে কাজ করবে।

দূর্নীতি দমনের ডিজিটাল কৌশল নিয়ে আমি এর আগে ফেসবুকে একটা লেখা দিয়েছিলাম, যেটা আমার ব্যক্তিগত ব্লগে পাওয়া যাবে। জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রেও এটি খুবই প্রাসঙ্গিক ও অত্যাবশ্যকীয়। যে কোন অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে বর্তমানে যে কারো তথ্য পেতে হলে বাংলাদেশের যে কোন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে উক্ত ব্যক্তির নামে কোন হিসাব আছে কিনা এবং কিরকম লেনদেন আছে তা জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সকল ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়ে বা ইমেইল দিয়ে তথ্য জানতে চায়। এতে প্রায়শই সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। পার্সোনাল আইডির সাথে ব্যাংক হিসাবের সংযোগ ঘটিয়ে তা সহজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটাবেইজে সংরক্ষণ করা যাবে এবং সেখান থেকে অতি সহজে সঠিক তথ্য বের করে ফেলা যাবে। কোন ব্যক্তিকে জঙ্গি কার্যক্রম বা জঙ্গি কার্যক্রমে সহায়তার জন্য সন্দেহ হলে তার বা তার আত্মীয়-স্বজন/সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সকল অর্থনৈতিক লেনদেন খুব সহজে বের করে ফেলা যাবে। বর্তমানে সকল জেলায় তথ্য অফিস রয়েছে। প্রতি পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদেও ডিজিটাল সেবা রয়েছে। এই ডাটাবেইজ তৈরি করার জন্য ভোটার করার মতো হুলস্থুল কর্মকাণ্ডেরও দরকার নেই। ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন দিয়ে এটি কয়েকমাসের মধ্যেই সম্পাদন করে ফেলা যায়। প্রয়োজন কেবল একটি সেন্ট্রাল সার্ভার এবং তার সাথে ইউনিয়ন/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনের সার্ভারের সংযোগ সাধন। একজন ব্যক্তির একটি এবং কেবলমাত্র একটি বাধ্যতামূলক পার্সোনাল আইডি দিয়ে কেবল অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, ঐ ব্যক্তির সারাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডগুলো, বিশেষ করে অপরাধ সংগঠন, গ্রেফতার, ইত্যাদি বিষয়গুলোরও রেকর্ড রাখা সম্ভব। এটা ব্যক্তিকে জঙ্গি কার্যক্রমই নয় কেবল যে কোন অপরাধ করতেই ভীত করবে, যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে কুরিয়ার সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লেনদেন হয়, এগুলোকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে অথবা নিয়ন্ত্রনে না আনতে পারলে বন্ধ করে দিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন রিপোর্টিং সফটওয়্যার/এ্যাপস তৈরি করে দেয়া যেতে পারে। এখন যেভাবে সহজে এক মিনিটের মধ্যে কোন রেকর্ড ছাড়াই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অর্থ প্রেরণ করা যায়, এটাকে বন্ধ না করলে অবৈধ অর্থ লেনদেন বন্ধ হবে না। অর্থ প্রেরণ সহজ করতে গিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না।

মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রনে সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অপরাধ হয় মোবাইল ব্যবহার করে। জ্বিনের বাদশা, কোম্পানি কর্তৃক পুরস্কার, অপহরণের পরে মুক্তিপণ আদায়সহ বহু ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রন করার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রনের কোন বিকল্প নেই। যে কোন স্থানে জঙ্গি গ্রেফতার হলেই তাদের কাছে অনেক মোবাইল সেট, প্রচুর মোবাইল সিম পাওয়া যায়। প্রতিটি ব্যক্তি যদি তার পার্সোনাল আইডি দিয়ে মোবাইল নম্বর নিতে বাধ্য হয় এবং তা যদি একটা ডাটাবেইজে সংরক্ষিত হয়, তাহলে মোবাইল ব্যবহার করে অপরাধ করা তথা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিনতর হয়ে যাবে।

৩. আইন সংস্কার ও দ্রুত বিচারঃ সকল প্রকার জঙ্গি সংশ্লিষ্ঠ অপরাধসমূহ অজামিনযোগ্য ও দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। বর্তমানে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জঙ্গিদের বিচার করতে হলে সরকারের অনুমতি নিয়ে হয়। গত ৭ জুলাই যুগান্তর পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত ১৩৬টি মামলা স্থবির হয়ে পড়ে আছে সরকারের অনুমোদন না পাওয়ার জন্যে। যে-বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া উচিত ছিলো তাকে স্থবির করে রাখা হয়েছে। আবার আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন পেয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। ২০১৩ সালে রাজিব হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেফতার করা হয়, ২০১৪ সালের শেষ পর্যন্ত এদের মধ্যে সাত জনই জামিনে মুক্তি পায়। সরকার, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইত্যাদির এমন কার্য একটাই প্রশ্ন তোলে, জঙ্গিবাদ দমনে সরকার কি আদৌ আন্তরিক? নাকি সব লোক দেখানো?

২০১৪ সালে আল্লামা শফি এক মাহফিলে বলেন, “নাস্তিকরা তোমরা মুরতাদ হয়ে গেছ, তোমাদের কতল (হত্যা) করা আমাদের ওপর ওয়াজিব হয়ে গেছে।“ কোন দেশে যেখানে আইন আছে সেখানে কোন ব্যক্তি এমন প্রকাশ্যে হত্যার ইচ্ছা প্রকাশ বা নির্দেশ দিতে পারে না। এ ধরণের কথা বলার জন্যে তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত হলেও তাকে আনা হচ্ছে না। বিচারের আওতায় আনা হবে কি, উল্টো ৪০ কোটি টাকার রেলওয়ের জমি হাটহাজারী মাদ্রাসাকে দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা প্রবাদটি এখানে প্রযোজ্য কিনা আমি জানি না। তবে আওয়ামী লীগ যে ফ্রাংকেনস্টাইন পুষছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আবদুর রাজ্জাক নামক এক ওয়াজকারী প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রবিরোধী, নারী স্বাধীনতাবিরোধী উস্কানীমূলক ওয়াজ করে যাচ্ছে; এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উপহাস, বিদ্রুপ করে যাচ্ছে, তাকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? প্রতিটি ওয়াজ মাহফিলে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিষেদগার করা হয়, তাদের কেন আইনের আওতায় এনে বিচার করা হচ্ছে না? এধরণের বিচারহীনতা জঙ্গিবাদকে উস্কে দিচ্ছে। প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার করা সম্ভব। প্রয়োজন হলে নতুন আইন করে এসবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। ওয়াজকারীদের ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক ভিডিওগুলো ‘বাংলা ওয়াজ সমগ্র’ ফেসবুক পেইজে পাওয়া যাবে।

জঙ্গিবাদের মামলাকে অজামিনযোগ্য করা হোক। জঙ্গিবাদের শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হোক। কোন ব্যক্তির শাস্তির মেয়াদ পূর্ণ হলেও যদি তার সংশোধন না হয়, যদি দেশ ও জনগণের জান-মালের জন্যে ক্ষতিকর রূপে প্রতীয়মান হয়, তাহলে তাকে জেলে রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করা হোক।

রাষ্ট্রের এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী পদক্ষেপ জঙ্গিবাদকে অনেকটাই কমিয়ে দিবে। কিন্তু জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করতে চাই আরো সাহসী পদক্ষেপ। প্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।

 

One Response

  1. farhad

Leave a Comment