খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধ

বন্দে মাতরম VS জনগণমন

লিখেছেনঃ উত্তম কুমার

রবীন্দ্রনাথ না বঙ্কিমচন্দ্র? জনগণমন আর বন্দে মাতরমের ভীষণ যুদ্ধ! রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের পক্ষে লিখছেন, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লিখছেন, এমনকি স্বয়ং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত লিখা হয়েছে বৃটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে! আর সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি এই জনগণমন গানটি রচনা করেছেন শক্তিশালী “বন্দে মাতরম” কে কাউন্টার করে।

অভিযোগের সবটুকু যে মিথ্যে তা নয়। ব্রিটিশ সরকার চাইছিল বঙ্কিমের বন্দে মাতরমের মত শক্তিশালী সঙ্গীতকে কাউন্টার করে পাল্টা সঙ্গিত রচিত হোক। আর শক্তিশালী গানের লেখাকে কাউন্টার করতে শক্তিশালী লেখকই পারেন। রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যগগণে। ইতোমধ্যে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসা কুড়িয়েছেন বহুবার। পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের এক ব্রিটিশ সরকারের অফিসার বন্ধু অনুরোধ করেছিলেন সম্রাটের জয়গান রচনা করতে। এবং রবীন্দ্রনাথ লিখেও ফেলেন। পঞ্চম জর্জ আগমনের কিছুদিন পূর্বেই লেখা হয়ে যায় দ্য মর্নিং সং অব ইন্ডিয়া- জনগণমন।
সম্রাট আগমনের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস তাকে স্বাগত জানানোর জন্য অধিবেশন করে। সেই অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে গীত হয় জনগণমন।
সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়, রবীন্দ্রনাথের গানটি সম্রাটের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।

(২)

এমন অভিযোগ যে আছে তা আগে জানতাম না। প্রথম জানতে পারি আমার কলেজের কমিউনিকেশন স্কিল এর শিক্ষক ড. শৌর্য পাটেল স্যারের কাছে। তিনি বাঙালী মহাবিপ্লবী ঋষি অরবিন্দ ঘোষের ভক্ত। তাই বাংলা না জানলেও বাংলাকে তিনি ভালবাসেন, আমার কাছে বাংলা শিখতে চেয়েছিলেন। স্যারকে বাংলা শেখাতে স্যারের বাড়ীতে গিয়ে তিনি এই কথা বলেন।

জনগণমন “অধিনায়ক”। জনগণ”মঙ্গলদায়ক”। জনগণ”ঐক্যবিধায়ক” । জনগণ”পথপরিচায়ক”। ভারত”ভাগ্যবিধাতা” । নাহ্। এই গান আসলেই ভারতমাতার উদ্দেশ্যে হতে পারে না। সবই পুরুষবাচক শব্দ। এটা পঞ্চম জর্জের জন্যই লেখা।
প্রথম ধাক্কাটি খেলাম।

এমন অভিযোগ আরো শুনতে থাকলাম। গান্ধীনগরে গুজরাতি বন্ধুর বাড়িতে তার বড় বোন পিএইচডি অধ্যায়নরত ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম নিয়ে। আমার প্রিয় সাবজেক্ট। আলাপ জমে উঠলো, তখনও একই অভিযোগ শুনি।

এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয়দের মধ্যেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আপত্তি দেখে অবাক হতে থাকি। আমি আগে জানতাম জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আপত্তির ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশিদের মধ্যেই দেখা পাওয়া সম্ভব, ওটা হিন্দু মা লা উ ন লেখকের রচনা বলে। কিন্তু ভারতীয়রাও যে নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে মনে মনে এমন বিরুদ্ধমত পোষণ করতে পারে তা জানা ছিল না।

(৩)

একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করি, আমার অন্যতম প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত- “ও আমার দেশের মাটি” তে একটা শব্দ আছে, শক্তিদাতা। রবীন্দ্রনাথ দেশমাতৃকাকে সম্বোধন করে বলেছেন, তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা। শক্তিদাতৃ নয়। তাহলে দেশমাতৃকা কে এমন পুরুষবাচক শব্দে ডাকা কেন?

হিন্দি ভাষায় প্রায় বেশিরভাগ শব্দ লিঙ্গভেদাশ্রিত। একদিন কলেজে ল্যাবে পাশে বসা গুজরাতি বান্ধবীর সাথে লাঞ্চ ব্রেকে একসাথে খাবো বলে জানালাম, “ব্রেক মে তেরে সাথ খাউঙ্গি”। সে ততক্ষণাৎ খিলখিল করে হেসে বললো, ল্যাড়কা ক্যা ল্যাড়কি? আমি একটু রসিকতা করে চোখ টিপ মেরে বললাম সন্দেহ আছে নাকি? 😉তখ আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে বললো, ছেলে হলে খাব কে খাউঙ্গা বলতে হয়, খাউঙ্গি মেয়ে রা বলে। হিন্দিভাষায় ক্রিয়াপদও ছাড় পায় নি। লিঙ্গভেদে আলাদা শব্দ।

বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ পুরোটাই লিঙ্গভেদ বিবর্জিত। ইদানিং বিশেষ্যপদেও এর বিলুপ্তি ঘটতে থাকছে। “প্রধান শিক্ষিকা” হয় না, নারী হলেও তিনি সম্বোধিত হন “প্রধান শিক্ষক”। এরকম, চিকিৎসক কে ডাক্তারনী ডাকা বিলুপ্ত হয়ে হয়ে অফিসিয়ালি ডাক্তার বলা হয়।

বাঙালী আজ যা ভাবে, রবীন্দ্রনাথ ভেবে রেখেছিলেন দেড়শো বছর আগে। তাই তো তিনি দেশের মাটি গানে শক্তিদাত্রী না বলে শক্তিদাতা বলেছেন দেশমাতৃকাকে। তবে কি জনগণমন তে ভারতভাগ্যবিধাতা আসলে ভারতমাতা?

জনগণমন এর চতুর্থ স্তবক টি দেখা যাক –
“ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥”

স্নেহময়ী তুমি মাতা। শব্দদুটির দিকে তাকালে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, সম্রাটকে স্নেহময়ী ও মাতা বলার কোনো কারণই থাকতে পারে না। এই অসাধারণ অনন্য সম্বোধনের অধিকারী দেশমাতৃকা তথা ভারতমাতা স্বয়ং।

তবে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সবচেয়ে কড়া জবাব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই দিয়ে গেছেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা একটি চিঠি তেঃ

“…সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন-অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।…”

(৪)

পরবর্তীতে এই জনগণমন গানটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম প্রস্তাব করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালে। পরে ১৯৪৩ সালে ৫ জুলাই আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা ঘোষিত হলে সেই দিন গানটি সর্বপ্রথম “জাতীয় সঙ্গীত” হিসেবে গাওয়া হয়। এরপর সেই বছরই ২৫ আগস্ট নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের কমান্ডার ইন চীফ হন এবং ২১ অক্টোবর গঠিত আজাদ হিন্দ গভঃমেন্ট এর সর্বাধিনায়ক তথা ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে গানটির হিন্দুস্তানী ভার্সন কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেন।

দেশভাগের পরে খণ্ডিত ভারতের বৃহৎ অংশে পার্লামেন্ট হাউসে ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদের সভাপতিত্বে ১৯৫০ সালে বাংলায় লেখা অরিজিনাল ভার্সনটিই পাকাপাকিভাবে জাতীয় সঙ্গীত (National Anthem Of India) হিসেবে গৃহীত হয়। সেই সাথে বন্দে মাতরমের অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে সেই সভায় তা ভারতের জাতীয় স্তোত্র (National Song Of India) হিসেবে জাতীয়সঙ্গীতের সমমর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে ঘোষিত হয়।

(৫)

অতএব বন্দেমাতরম কে কাউন্টার করার লোক রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন না। বরং বন্দেমাতরম ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা। বন্দে মাতরম পৃথিবীর এক মাত্র গান যেটা একশোটিরও বেশি সুরে গাওয়া হয়েছে, প্রত্যেকটি সুরই সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম সুরটি রবীন্দ্রনাথ নিজে করেছেন। শুধু সুরই করেন নি, নিজের কণ্ঠে গেয়েছেন বহুবার।

১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বন্দেমাতরম ধ্বনি ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথের মহামিছিলের দমকা হাওয়ায় ভীত হয়ে এক মাসের মধ্যেই বন্দেমাতরম নিষিদ্ধ ও কার্লাইল সার্কুলার জারি করে ব্রিটিশ সরকার। এরপরে ক্ষুদিরাম বোসের ফাঁসির মঞ্চে শেষ শব্দ বন্দেমাতরম হয়ে যায় সশস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাষণ। এইরকম নিষিদ্ধ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ এইচ বোস কোম্পানির সিলিন্ড্রিক্যাল রেকর্ডে নিজ কণ্ঠে বন্দেমাতরম গেয়ে রেকর্ড করে বসেন। তারপর থেকে বন্দেমাতরম গানটি রেকর্ড করাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। (রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে রেকর্ডকৃত বন্দেমাতরম গানটি আমার সংগ্রহে আছে, নৈহাটিতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির পাঠাগার থেকে কেনা সিডি তে)

বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম গানে যে মহাশক্তির বীজ বপন করে গেছেন তাকে ফুলে ফলে জাগ্রত করে ছড়িয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ।

স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের বারংবার বন্দেমাতরম ব্যবহারে লর্ড কার্জন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে ভক্তরা তার জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিকে দিয়ে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তা চ্যান্সেলর হিসেবে নিজস্ব ক্ষমতাবলে বানচাল করে দেন লর্ড কার্জন।
………………….
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment