ব্লগার ও লেখক হত্যা বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান থেকে প্রধানমন্ত্রী সবাই মুসলিমদের সাথে তাল মিলিয়ে ব্লগারদের লেখাকে উস্কানীমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সর্বশেষ এ ব্যাপারে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম। ডয়েচে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ব্লগাররাই তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে।“ আমি এক পোস্টে ইমাম সাহেবের সাক্ষাৎকারের একটা জবাব দিয়েছিলাম। এই পোস্টে আমি ব্লগারদের লেখা ছাড়াও আরো যেসব বিষয়কে মুসলিমরা উস্কানীমূলক মনে করে, তার একটি ক্ষুদ্র তালিকা করেছি। ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক। ক্রমশ জাতীয় ও আন্তর্জার্তিক বিষয়েও আলোকপাত করা হবে।

১. ২০০৮ সালে আমি পটুয়াখালীতে চাকুরী করছিলাম। আমাদের ব্যাংকের সামনে পুরান আদালতের বিশাল মাঠে চরমোনাই পীরের মাহফিল। মাহফিলে চরমোনাইর পীর রেজাউল করীম তার ওয়াজে বললেন, “…….এভাবে একশ হাজারে এক লক্ষ, একশ লক্ষে এক মিলিয়ন, একশ মিলিয়নে এক বিলিয়ন, একশ বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন….।” আমি তো শুনে হাহাপগে। কয় কী বেটা! একশ মিলিয়নে এক বিলিয়ন! আর একশ বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন! পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের এটা জানালে হিন্দু হয়েও আমি হুজুরের ভুল ধরতে গেলাম কেন, এই দাবিতে একজন আমার ওপর কেবল ক্ষুন্নই হলেন না, চটেও গেলেন। আমার নাকি এ ধরণের ‘উস্কানিমূলক’ কথা বলা ঠিক না।

২. তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং খালিশপুরে থাকি। খালিশপুরে দেলোয়ার হোসাইন সাইদির ওয়াজ ফেরত একদল উচ্ছৃঙ্খল মুসলিম বাসায় ফেরার পথে পথে তাণ্ডব চালিয়েছে। পথে যতো ‘উস্কানিমূলক’ সিনেমার পোস্টার ও বিজ্ঞাপন ছিলো তা ছিড়েছে এবং সিনেমা হলে ঢিল ছুড়েছে। সব মিলে এমন এক হুলস্থুল কাণ্ড যে, আমরা ভেবেছিলাম দাঙ্গা লেগে গেলো বুঝি।

৩. ২০১৫ সালের হজ্ব চলাকালীন শয়তানকে ঢিল ছুড়তে গিয়ে পদদলিত হয়ে কয়েকশ মুসুল্লি মারা গেলে সাতক্ষীরার মোহন কুমার মণ্ডল এক ফেসবুক সৌদি আরবের সমালোচনা করেন। তিনি শয়তান নিয়ে একটা স্যাটিরিক মন্তব্যও জুড়ে দিয়েছিলেন সাথে। স্ট্যাটাস দেবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার বাড়ির ওপর মুসলমানরা চড়াও হয়। ‘উস্কানিমূলক’ স্ট্যাটাস দেয়া ও মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে আমরা বহুজনকেই এভাবে গ্রেফতার হতে দেখেছি। তার মধ্যে কেবল ফেসবুকার নয়, রয়েছে লেখক, প্রকাশক থেকে প্রিন্টার এন্টারপ্রাইজের মালিকও।

৪. বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে মঙ্গলশোভাযাত্রা ও গানে-নৃত্যে-কবিতায় নববর্ষ উদযাপনকে মুসলিমরা হারাম মনে করে। পূর্বে এর বিরুদ্ধে ওয়াজ মাহফিল থেকে কিছু বিষেদগার শোনা যেতো। কিন্তু বর্তমানে বহু শিক্ষিত লোককেও ফেসবুকে ঐ মতকে সমর্থন করতে দেখা যায়। এমনও দেখা গেছে যে, মসজিদে ইমামরা নামাজীদের শপথ পড়িয়েছেন যেন পহেলা বৈশাখে বাইরে না যাওয়া হয়। ইসলামের নবী নববর্ষ উদযাপনকে নিষেধ করে গেছেন, তাই পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি উস্কানীমূলক অনুষ্ঠান। এই উস্কানীতে উত্তেজিত হয়ে ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলা করেও নববর্ষ উদযাপন থামানো যায়নি। তবে ভবিষ্যতেও যে তারা থামাতে পারবে না, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। কোনদিন হয়তো সরকারই বলবে, কোরান-সুন্নাহ পরিপন্থী এ ধরণের উস্কানীমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ হোক।

নববর্ষ পালন সম্পর্কে আলেমদের মতামত

৫. দেশে ধর্ষণ বাড়ছে। এর কারণ বহুবিধ। অশিক্ষা-কুশিক্ষা, যৌনশিক্ষার অভাব থেকে বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বিভিন্ন বিষয় এর সাথে জড়িত। কিন্তু আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা ভিকটিমের পোশাক ও চলাফেরার ওপর দোষ চাপাতেই পছন্দ করেন। তাদের মতে নারীরা ‘উস্কানিমূলক’ পোষাক পরে ও ‘উস্কানিমূলক’ চলাফেরা করে বলেই ধর্ষিত হয়। বোরকা পরলেই নাকি ধর্ষণ কমে যেতো।

৬. হাইকোর্টের সামনে লেডি জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্যটি রাস্তা থেকে দেখা যেতো বলে তা উৎপাটনের আন্দোলন আমরা দেখেছি। মুসলমানদের কাছে ‘উস্কানিমূলক’ এই ভাস্কর্যটি শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছেও উস্কানিমূলক বিবেচিত হয়েছিল এবং সেটাকে সরিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল।

৭. (সম্ভবত) ২০১০ সালে সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার দিয়ে সরকার নারী নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলো। কোরানে নারীকে পুরুষের অর্ধেক মনে করা হয় এবং সেভাবে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করার বিধান দেয়া আছে। মুসলমানরা তাই সরকারের সেই ‘উস্কানিমূলক’ নীতির বিরোধীতা করে বিশাল বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিলো। শেষ পর্যন্ত সরকারও বিবেচনা করে দেখলো যে, সত্যিই নারী নীতি একটি উস্কানিমূলক সিদ্ধান্ত ছিল। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে নারী নীতিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।

৮. শিশু ও কিশোরদের বাংলা পাঠ্যসূচীতে হিন্দু ও সেক্যুলার লেখকদের প্রাধান্য থাকা নিঃসন্দেহে উস্কানীমূলক কাজ। এতে মুসলিম শিশুরা অমুসলিমদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধে আক্রান্ত হতে পারে, যা কোরানে আল্লাহর নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সুতরাং মুসলমানরা এর বিরোধীতা করলো এবং সরকার তাদের দাবি মেনে নিলো।

৯. বিবর্তনবাদ যতোই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব হোক না কেন, কোন বিশ্বাসী মুসলমানই বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে পারে না, কারণ তা কোরানের সাথে সাংঘর্ষিক। বিবর্তনবাদকে ভুয়া প্রমান করার জন্য পৃথিবীর দেড়শ কোটি মুসলমানের মতো জাকির নায়েকও খুব সোচ্চার। এরকমই একটা বক্তৃতায় দেখা যায় জাকির নায়েক ৫ মিনিটের ভিডিওতে ২৫টি ভুল বা মিথ্যা তথ্য দেয়, যার মধ্যে ডারউইন যে জাহাজে চড়ে গ্যালাপাগোস-এ গিয়েছিলেন সেই জাহাজের নাম, দ্বীপের নাম, পাখির নাম, বিজ্ঞানীদের নাম তো রয়েছেই; সেই সাথে সে কিছু উদ্ভট বানানো নাম চালিয়ে দেয় বক্তৃতায় এবং সবচেয়ে হাস্যকর হলো, বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে নাকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো, এমন ডাহা মিথ্যা কথাও বলে। এখন খুব একটা না দেখা গেলেও পূর্বে দেখা যেত, ভিডিওটির ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া আরেকটি ভিডিওকে যারাই ফেসবুকে শেয়ার করতো, তাদেরকেই মুসলমানরা গালি দিয়ে ধুয়ে ফেলতো। কোন যুক্তিতর্কের ধার ধারতো না তারা। কেউ কেউ দাবি করতো জাকির নায়েকের সমালোচনা আসলে ইসলামের সমালোচনা, যা ‘উস্কানীমূলক’।

https://www.youtube.com/watch?v=x6oQrgR4ES0

বিবর্তন সম্পর্কিত জাকির নায়েকের কৌতুক

১০. আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে সকল প্রকার নারী-শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। পাকিস্তানের তালেবান অধ্যুষিত অঞ্চলে বাস করেও মালাইলা স্কুলে যেতেন এবং তার ব্লগে নারী-শিক্ষাকে প্রোমোট করতেন, যা তালেবানদের কাছে উস্কানীমূলক বলে বিবেচিত হয় এবং তারা মালালাকে গুলি করে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম একেকবার স্কুলে এবং গ্রামে হামলা করে কিশোর বয়সের সকল মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়, যাতে তারা স্কুলে গিয়ে শিক্ষা নিতে না পারে।

১১. ফিলিস্তিনের একটা ভিডিও দেখেছিলাম, যাতে দেখা যায় এক বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষ্যে ‘উস্কানীমূলক’ গান-বাজনা চলছিলো বলে হামাস সংগঠনের লোকেরা এসে সেখানে এলোপাথারি গুলি করতে শুরু করে। সিরিয়ার আরেকটা ভিডিও দেখেছিলাম, যেখানে এক নারী একা বাইরে বের হওয়ার জন্য তাকে অনেকে ঘিরে ধরে কোরানের কিছু আয়াত উচ্চারণ করে মাথা বরবার গুলি করে।

১২. আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এসে কাবুল শহরের ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উড়ানো খেলা বন্ধ করে দিয়েছিলো এই মর্মে যে, ইহা ইসলাম পরিপন্থী। বাংলাদেশে পুরান ঢাকায় এখনও ঘুড়ি উৎসব হয়। একদিন হয়তো সেটাও উস্কানিমূলক বিবেচিত হবে এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে।

১৩. আইএস ইরাকের ওয়াজেদি সম্প্রদায়ের বহুসংখ্যক পুরুষদের হত্যা করেছে, নারীদের ও শিশুদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। তাদের দোষ, তারা সুন্নী ইসলামের অনুসারী নয়। তারা বহু ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি ধ্বংস করা ছাড়াও ইসলামের বেশ কয়েকজন তথাকথিত নবীর মাজার উড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও মাজারগুলোতে ইসলামিস্টদের হামলা আমরা দেখেছি। এছাড়াও আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তাদের অনেকদিনের। পাকিস্তান তো সাংবিধানিকভাবেই আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির ও মূর্তি ভাঙা, ওয়াজ মাহফিলে তাদের ধর্মীয় আচারের বিরুদ্ধে বিষেদগার করা এক নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। মুসলিম প্রধান দেশে অন্য ধর্ম পালন ‘উস্কানিমূলক’ বলে দাবি করে না মুসলিমরা, তারা অমুসলিমদের সমূলে উৎখাত চায়। আর তারা যে কেবল অমুসলিমদের উৎখাত চায়, এমনই নয়, সুন্নীরা শিয়া, আহমাদিয়া, ইয়াজিদি, সুফীসহ সকল অসুন্নীদের অমুসলিম মনে করে ও তাদের বেঁচে থাকারই অধিকার দিতে চায় না। আমরা হয়তো কোনদিন দেখবো, বাংলাদেশের সরকারও তা বিবেচনায় নিয়েছে এবং পাকিস্তানকে অনুসরণ করে অন্যদের অমুসলিম ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে।

উপরোক্ত সত্য ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সভ্য পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা মুসলিমদের কাছে উস্কানিমূলক নয়। তবে কি আমরা সভ্যতার সকল উপাদানকে ছুড়ে ফেলে অসভ্যতায় ফিরে যাবো? ফের গুহা-মানব যুগে ফিরে নতুন করে সভ্যতা শুরু করবো? নাকি যারা একখানা উস্কানিমূলক গ্রন্থ পড়ে পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতাকেই উস্কানি হিসেবে গ্রহণ করছে, তাদের অসভ্যতার হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর লড়াই করবো?

Leave a Comment